Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৬০। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

বাংলার বাঘ
আশুতোষ বিনোদ মন্ডল
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বই দোকানে নতুন কোনো বই এসেছে কি না খোঁজ নিতে ব্যস্ত। এমন সময় এক নবীন কিশোর তার চিকিৎসক বাবার সাথে দোকানে ঢুকল। চিকিৎসক ও অধ্যাপকের পূর্ব পরিচয় ছিল। স্বভাবত:ই তাঁর সন্তানকে গাল টিপে আদর করেন বিদ্যাসাগর। পাঠে খুব আগ্রহ শুনে উপহার দেন এক কপি রবিনসন ক্রুসো। সংগে অটোগ্রাফ ও শুভেচ্ছাবার্তা – ‘মনোযোগ দিয়ে পোড়ো।’ কথা রেখেছেন সেই কিশোর। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (২৯ জুন ১৮৬৪ — ২৫ মে ১৯২৪)।

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

কেমন কথা রেখেছেন? লেখাপড়াকে জীবনের অবসেসন করে তুলেছেন। তখনকার দিনে ক্লাস থ্রিতে যখন পড়ছেন মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট` এর প্রথম পরিচ্ছেদ কণ্ঠস্থ। ইংরেজিতে লেখা ইতিহাস বই বাংলায় অনুবাদ করছেন। ৩ খণ্ডে। অন্যদিকে বাংলায় লেখা কথামালা, বোধোদয়, আখ্যানমঞ্জরী অনুবাদ করছেন ইংরেজী ভাষায়। তখন এফ এ ক্লাসে। পরে কলেজে পড়ার সময় হঠাত্‍ মাথায় চাপল ফরাসি ভাষায় লেখা জব্বর অঙ্ক বইগুলো পড়া দরকার, শেখা শুরু করলেন ফরাসি ভাষা। কখন কী পড়ছেন – লিখে রাখছেন ডায়েরিতে। কখনো সংস্কৃত, কখনো পালি। কখনো অঙ্ক কখনো পদার্থবিদ্যার বাঘা বাঘা বই।

বই কিনছেন দেদার। সেজন্য যাচ্ছেন নীলামঘরেও। বিদেশী প্রকাশকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। জার্মানী, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে। বাবার মৃত্যুর পর বই খাতে খরচের হিসেব নিজে রাখা শুরু করেছেন। শুধু কি বই? বই এর জন্য কেনা রাক, সেল্ফ এমনকি আলমারির খরচও লেখা আছে খাতায়। সারা জীবন ধরে কেনা ৮৫ হাজারের বেশি বই জাতির উদ্দেশ্যে দান করে গেছেন। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ‘আশুতোষ কালেকশন’ নামে সংরক্ষিত। সে বাজারে যে গ্রন্থ সমূহের আনুমানিক ক্রয় মূল্য ৫ লক্ষ টাকা। ৯০০০ বর্গ ফুট এলাকা জুড়ে ১৩৫০০ ফুটের বেশি শেলফে যা প্রদর্শিত ও প্রতিরক্ষিত।

ভবানীপুরের বিখ্যাত ডাক্তার গঙ্গাপ্রসাদ মুখার্জী ও জগত্তারিণী দেবীর সন্তান আশুতোষ প্রেসিডেন্সীতে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছেন আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং স্বামী বিবেকানন্দকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে (১৮৮৫) এবং পদার্থবিদ্যায় (১৮৮৬) এম. এ. করেছেন। অর্জন করেছেন প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি (PRS), যা তাঁর স্বপ্ন ছিল। তাঁর জীবনের দ্বিতীয় স্বপ্ন ছিল হাইকোর্টের বিচারক হওয়ার। তা পূরণের লক্ষ্যে ১৮৮৮তে বি. এল.এবং ১৮৯৪তে আইনের উপর ডক্টরেট করেছেন। যার ফলে ১৮৯৮ তে ট্যাগোর ল প্রফেসর হন। ১৯০৪এ বিচারপতি হন ।

লেখাপড়া তাঁর যে অবসেসন ছিল তা প্রমাণ হয়ে যায় – তাঁর নামের পাশে বহুল পরিচিত উপাধিগুলোতে চোখ রাখলে। কে টি সরস্বতী, শাস্ত্র বাচস্পতি, সম্বুদ্ধাগম চক্রবর্তী, MA, DL, DSc, PhD, DSc, CIE, CSI, FRAS, FRSE., FRIE ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর জীবনী লেখকগণ বলছেন ,তিনি পালি রুশ ফার্সি ভাষায় রীতিমত পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর অসাধারণ মেধায় আকৃষ্ট হয়ে সাহেব উপাচার্য্য সস্নেহে প্রশ্ন করেন হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?উত্তরে স্বপ্নদর্শী অাশুতোষের প্রত্যয়ী জবাব – আমাকে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য করে দিন। তখন তাঁর বয়স ২১। সেই স্বপ্নও পূরণ হল – ২৫ বছর বয়সে।

১৮৮৯ সালের হিসাব বলছে – তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী সদস্য হয়ে উঠেছেন। যে প্রভাব চলতে থাকবে বিশ শতকের প্রথম সিকি ভাগ পর্যন্ত। কেন না এই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য হিসেবে ১৯০৬ — ১৯১৪ এবং ১৯২১ — ১৯২৩ পর্যন্ত তিনি রাজ করবেন। মধ্যবর্তী সময়টুকুতেও তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ কথা। প্রথম ভারতীয় উপাচার্য্য হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন সময়টা বড় সুখের ছিল না। ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব এবং তার আগে ১৯০৪এ এই কার্জনেরই শিক্ষা সংকোচনের নীতি ভারতবাসীর মনে অসন্তোষের জন্ম দেয়।

শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। জাতীয় নেতারা ইংরেজ শাসন ও আইন, আদালত বয়কট ,বিলেতি দ্রব্য বয়কট – এই তিন ধারায় বয়কটের ডাক দেন। প্রয়োজন হয় বিদেশি শিক্ষার বিকল্প হিসেবে স্বদেশি শিক্ষার ব্যবস্থা। গড়ে ওঠে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’। স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ইংরেজদের প্রবর্তনায় স্কুল কলেজকে বয়কটের ডাক দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘গোলদীঘির গোলামখানা’ আখ্যা দেন।
জাতীয় আন্দোলনের এই ঝোড়ো দিনগুলোতে সন্দেহ নিন্দা ও বিতর্কের বাতাবরণে আশুতোষ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরেন। শুধু হাল ধরা নয়, লর্ড কার্জনের বহু নিন্দিত ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনের (১৯০৪) সুচিন্তিত প্রয়োগ শুরু করেন।

আশুতোষের নীতি হল – ১. ব্যাপক ভাবে স্কুল কলেজের স্বীকৃতি দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার প্রসার । ২. শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে নেওয়া। ৩. উচ্চতর শিক্ষার স্তরে মাতৃ ভাষায় পঠন -পাঠনের পরিকল্পনা। ৪.বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব প্রদান।
৫. দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন পেশার মেধাবী ও গুণী মানুষদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ। ৬. বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় যত্নবান হওয়া সর্বোপরি ৭ .বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে নানা ফ্যাকাল্টিতে গবেষণার উন্নয়ন ও গবেষণাকার্যে উৎসাহ দান। তাই লর্ড লিটন বলেছেন In the eyes of his countrymen and in the eyes of the world, he represented the university so completely by that for many years sir Asutosh was infact the university and the university sir Asutosh.

নানা বিষয়ে আগ্রহী এই মানুষটির ধ্যানবিন্দু ছিল গণিত। ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অফ সায়েন্স এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি । সেখানে ১৮৮৭ থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত গণিত সহ নানা বিষয়ে পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষণ দেন। ১৮৯৩ তে লেখেন ‘জিওমেট্রি অব কোনিক্স’। তাঁর ল অফ পারপিচুইটস গ্রন্থটি ও (১৮৯৮) যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল। ১৯০৮ সালে অঙ্কের প্রতি অন্ধ প্রেমের কারণে শত ব্যস্ততা সত্বেও প্রতিষ্ঠা করেন ‘ক্যালকাটা ম্যাথামেটিকাল সোসাইটি’।
মিতাহারী মানুষটি চা পানও খেতেন না কখনো। ছিলেন সম্পূর্ণ নিরামিষাশী। কাঁচাগোল্লা ও সন্দেশে অনুরাগী ছিলেন শ্যামাপ্রসাদের জনক। ট্রেনে চেপে আলিগড় ভ্রমণের পথে সাহেবের সাথে তাঁর সরস বাক বিনিময় এখনো সমান উপাদেয় । “আপনার কোট আমার জুতো খুঁজতে গেছে।”
মামলার কাজে সমান ব্যস্ত ছিলেন তিনি। সারা জীবনে দুহাজারের বেশি রায় দিয়েছেন। মামলার কাজে পাটনা গিয়েই তিনি অসুস্থ হন এবং সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা এবং শবানুগমনের ইতিহাস সেকালের কাগজগুলি সযত্নে ছেপেছিল। তাঁর স্মরণ সভায় সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন – “আজ যে বাংলা ভাষায় কথা বলছি সেজন্য আমরা স্যার আশুতোষের নিকট কৃতজ্ঞ! ….. তিনি বাংলা ভাষাকে সেযুগে ইংরেজির সমান মর্যাদা দেন।” বাস্তবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘আশুতোষ স্মৃতিকথা’য় বিস্তারিত আলোচনা করে গেছেন। একটা ছোট্ট নমুনা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা মনে হয়। ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া শ্যামাপ্রসাদকে সদ্য গঠিত বাংলা বিভাগে এম. এ. পড়ার জন্য ভর্তি করে দিলেন উপাচার্য্য পিতা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। খাঁটি বাঙালিয়ানার জন্যে আজীবন বিনম্র শ্রদ্ধায় বিদ্যাসাগরকে বুকে বয়েছেন। বিধবা কন্যা কমলার পুনর্বার বিয়ে দিয়েছেন, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ।

- Advertisement -
Latest news
Related news