Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৫৮।। অরবিন্দ ঘোষ; বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

রুদ্রদূত
অরবিন্দ বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

“দেবতার দীপ হস্তে যে আসিল ভবে
সেই রুদ্রদূতে বল কোন রাজা কবে
পারে শাস্তি দিতে!” – রবীন্দ্রনাথ
১৮৫১। মেদিনীপুর কলিজিয়েট স্কুলে প্রধান শিক্ষক হয়ে এলেন ঋষি রাজনারায়ণ বসু। এখানেই তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা স্বর্ণলতা দেবীর সংগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিলেতফেরত বিখ্যাত চিকিৎসক কৃষ্ণধন ঘোষ। ব্রাহ্মনেতা হওয়ার সুবাদে মেদিনীপুরের সেই ঐতিহাসিক বিবাহবাসরে উপস্থিত ছিলেন ব্রাহ্মসমাজ ও জাতীয় আন্দোলনের বহু উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। এই স্বর্ণলতা দেবীর প্রথম সন্তান অরবিন্দ ঘোষ (১৫ আগস্ট ১৮৭২ — ৫ ডিসেম্বর ১৯৫০)।

পৈত্রিক নিবাস হুগলীর কোন্নগরে। বাবা যোগ দিয়েছিলেন রঙপুর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের পদে। সেই সুবাদে শৈশবে কয়েকবছর রঙপুরে কাটে অরবিন্দের। পরে দার্জিলিং এর লোরেটো কনভেন্ট স্কুলে (১৮৭৭ -১৮৭৯) পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে ভর্তি করা হয় তাঁকে। এরপর বিলেত যাত্রা। প্রথমে ম্যানচেস্টার শহরে। পরে লন্ডনের সেন্ট পলস স্কুলে (১৮৮৪) তিনি ভর্তি হন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কিংস কলেজ থেকে আই সি এস পরীক্ষার লিখিত অংশে সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু ততদিনে মনে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও দেশের প্রতি ভালোবাসার জাগৃতি ঘটেছে। ভেবে দেখলেন আই সি এস হওয়া মানে তো ব্রিটিশের সেবা করতে হবে! চূড়ান্ত ধাপের ‘অশ্বারোহন’ পরীক্ষার দিন অনুপস্থিত থেকে গেলেন অরবিন্দ!

১৮৯৩ তে ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে লক্ষ্যে একাগ্র অরবিন্দ বিলেত ছেড়ে দেশে ফিরে এলেন। বরোদা স্টেট সার্ভিসে যোগ দিলেন। প্রথমে সেটেলমেন্ট বিভাগে, পরে কোষাগার হয়ে সচিবালয়ে।নতুন কাজ হল গায়কোয়াড়ের জন্য বক্তৃতার খসড়া রচনা। বই-বুঁদ মানুষটির অভিযোজন হল না এই পদে। এবার তাঁকে নিয়োগ করা হল বরোদা কলেজে। ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার শিক্ষক (১৯০০) হলেন তিনি। দেশের নতুন প্রজন্মকে তৈরি করার কাজে আনন্দ পেলেন। ধীরে ধীরে এখানে অধ্যক্ষ হন (১৯০৪) তিনি। ইতিমধ্যে মৃণালিনী দেবীর সাথে (১৯০১) বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ধীরে ধীরে বরোদার নানা বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠনের সাথে যোগাযোগ ঘটল। এবার লক্ষ্য -সারাদেশের অসংখ্য স্থানীয় সংগঠন গুলোকে কীভাবে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা যায়। অনুজ বারীন্দ্রকুমারকে প্রেরণ করলেন বাংলায়। সলতে পাকানোর উদ্দেশ্যে।

ভারতবর্ষের ইতিহাস অরবিন্দকে মনে রাখবে জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে। মনে রাখবে বিশিষ্ট দার্শনিক ও অধ্যাত্ম সাধক হিসেবে। ১৯০৩ সালেই বরোদাবাস কালে ‘আপস নয়’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন তিনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবীদের মধ্যে গোপনে এই পুস্তিকা প্রেরিত হয়। কিন্তু ১৯০৫এ বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পর অরবিন্দ আর নেপথ্য নায়ক থাকতে পারলেন না। বরোদার চাকরি ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে চলে এলেন বাংলায়। তার আগে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘুরে ঘুরে সংগঠন গড়ার চেষ্টা করেছেন। আলাপ হয়েছে লোকমান্য তিলক, ভগিনী নিবেদিতার সাথে। বাঘা যতীনকে বরোদা রাজ্যের সেনাবিভাগে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ঢুকিয়ে ছিলেন। কলকাতায় এসে সরাসরি আসরে অবতীর্ণ হলেন। যুক্ত হলেন স্বরাজ সাধনায়।

১৯০৬এ কলকাতায় জাতীয় কলেজের অধ্যক্ষ পদে অভিষিক্ত হলেন অরবিন্দ ঘোষ। বর্তমানে যার নাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। পাশপাশি বিপিনচন্দ্র পালের ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার ইংরেজি ভার্সনের সম্পাদক হলেন তিনি। জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষাবোধ জাগ্রত করতে খরশান কলম নিরলস আগুন উগরে দিল। অতিষ্ঠ ব্রিটিশ শাসকের তখন মরিয়া অবস্থা। জনৈক লেখকের রচনাকে দেশবিরোধী বলে দেগে দিয়ে বিপিনচন্দ্র পাল এবং অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহমূলক প্রচারের অভিযোগে মামলা রুজু হল। বিপিনচন্দ্রের ছয় মাস জেল হল। অরবিন্দ প্রমাণাভাবে মুক্তি পেলেন (১৯০৭) ।

দক্ষ সংগঠক অরবিন্দ মাত্র পাঁচ বছর সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। এরমধ্যে তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি স্বচ্ছ অভিমুখ নির্ধারণের প্রয়াস নেন। প্রথমতঃ, নিরন্তর গুপ্ত বৈপ্লবিক প্রচার কর্মসূচি, সমস্ত বিদ্রোহের প্রস্তুতির জন্য সংগঠন গড়ে তোলা। দ্বিতীয়তঃ ,অখণ্ড জাতিকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ ভাবে উদ্বুদ্ধ করা। তৃতীয়তঃ অসহযোগ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে নতুন নতুন এলাকায় অনেক নতুন মানুষকে সংগঠিত করা। তাঁকে নিয়ে বিব্রত ব্রিটিশ পুলিশ দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার করে ৩মে ১৯০৮। এবার আলিপুর বোমা মামলায় আটক করা হল।

ঐতিহাসিক সে মামলার রায়ে বারীনের দীর্ঘ কারাবাস হয়। কিন্তু এবারও শেষ বিচারে অভিযোগমুক্ত হন তিনি ।আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে ছাড়া পান ৬ মে ১৯০৯এ । এই জেল জীবনে অরবিন্দের মানসিক পরিবর্তন ঘটে যায়।১৯১০এ রাজনীতি ছেড়ে পণ্ডিচেরিতে প্রস্থান করেন ।
পণ্ডিচেরিতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন অরবিন্দ। হয়ে ওঠেন ঋষি অরবিন্দ। দার্শনিক অরবিন্দ। নিবিড় ও গভীর অধ্যাত্ম ভাবনাগুলি লিপিবদ্ধ আছে বাংলা ও ইংরেজিতে রচিত গ্রন্থমালায়। মোট ৩৮ টি গ্রন্থের মধ্যে কয়েকটির বিষয় রাজনীতি হলেও সিংহভাগ ধর্মভাবনা আধারিত। অধ্যেতব্য গ্রন্থগুলি হল – The Life Divine ,Essays on Gita, Speeches of Aurobinda ইত্যাদি ।

তাঁর সুবিশাল দার্শনিক চিন্তার সারাৎসার হল:-
ক) সব ব্রহ্মজাত এবং ব্রহ্মে লয় প্রাপ্ত। খ) জীবন ও মৃত্যু একই চক্রের দুই পিঠ -এটাই আত্মার পুনরুজ্জীবন। গ)বিশ্বজগতের যা শাশ্বতনীতি তাইই মানবাত্মা ও নিখিল প্রকৃতির পরিণাম নির্ধারিত। ঘ) মানুষের লক্ষ্য হল দিব্যজীবন ,যা ব্রহ্মে লীন হয়,আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬) উপন্যাসের সন্দীপ চরিত্রটিকে এঁকেছেন অরবিন্দ ঘোষের আদলে। এই ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধুর প্রতি আজীবন অগাধ শ্রদ্ধাবোধ পোষণ করেছেন। যাঁর একসময় ধ্যানজ্ঞান স্লোগান ছিল ‘India for Indians’ .কবিগুরু তাঁদের হিংসাত্মক পথের অভিভাবক সুলভ সমালোচনা করেছেন আবার অন্তরে তাঁদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেছেন নিরন্তর। দুজনের দীর্ঘ যোগাযোগহীনতার অবসান হয় ১৯২৮ সালে। দাক্ষিনাত্য ভ্রমণের সময় পণ্ডিচেরির আশ্রমে গিয়ে অরবিন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এবিষয়ে বহু লেখায় ও চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ একতরফা বহু কথা বলেছেন। কিন্তু অরবিন্দ নীরব থেকেছেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘অরবিন্দ ঘোষ’, শিরোনামে যে প্রবন্ধ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ তার উপসংহারে আছে” অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলুম, সেখানে তাঁকে জানিয়েছি – অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার। আজ তাঁকে দেখলুম তাঁর দ্বিতীয় তপস্যার আসনে, অপ্রগলভ স্তব্ধতায় -আবার তাঁকে মনে মনে বলে এলুম – অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।” এখনো অন্ধকারে মন বিচলিত হলে অরবিন্দের অনুচ্চ আহ্বান হৃদয় মদ্রিত করে -তাঁর বাণীতে দিশা পাই ,- ‘আলোর দিকে ফিরে থাকাই দরকার, আলো খুব কাছে আছে, হঠাত্‍ এসে পড়তে পারে’।

- Advertisement -
Latest news
Related news