Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৫৫ ।। হরিচরণ মালাকর ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

বঙ্গ – শব্দ – মালাকর
হরিচরণ বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

“কোথা গো মেরে রয়েছ তলে ,
হরিচরণ, কোন গরতে?
বুঝেছি শবদ-অবধি-জলে
মুঠাচ্ছ খুব অরথে ।”
মনস্বী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রদ্ধা ও শংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন যে মানুষটির সারা জীবনের তপস্যায় মুগ্ধ হয়ে, তিনি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (২৩-০৬ -১৮৬৭ — ১৩-০১ – ১৯৫৯)।
আত্মপ্রচার বিমুখ, নিবিড় গবেষক, সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এই মানুষটির জন্ম চব্বিশ পরগনার রামনারায়ণপুর গ্রামে। ঠাকুরদা কাশীনাথের পৈত্রিক ভিটে ছিল যশোর জেলার ঝাঁপামস্যিনগরে। যশাইকাটিতে শ্বশুরের দেওয়া জমিতে বাড়ি করেন কাশীনাথ। কাশীনাথের দুই ছেলে। নিবারণ ও উমেশ। নিবারণ শৈশবে বাবা ও ভাইকে হারিয়ে মামাবাড়িতে বড় হন। মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ে করেন রামনারায়ণপুর গ্রামের বালক চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পাঁচ বছর বয়সী কন্যা জগৎমোহিনীকে। তাঁদের বড় ছেলে হরিচরণ। এই হরিচরণের পাঁচটি কন্যা সন্তান। কোনো পুত্র ছিলনা। তাই নিজের সেজো ভাই তারাচরণের বড় ছেলে সত্যেন্দ্রনাথকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করেন। তিনি ১৯১৮ সালে জ্যেঠুর নির্দেশে শান্তিনিকেতনে যোগ দেন এবং হরিচরণের সাথে থেকে যান।

ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্র-সান্নিধ্য ঘটে হরিচরণের। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয় শিক্ষা ও কলেজ জীবন কাটানোর পরে পতিসরের কাছারি বাড়িতে এক সময় সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) বি. এ. তৃতীয় বর্ষ পড়ার সময় প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছেদ পড়ে। কিন্তু কাছারি পরিদর্শন করতে গিয়ে হরিচরণের সংস্কৃতচর্চায় আগ্রহ দেখে কবিগুরু তাঁকে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে সংস্কৃত শিক্ষক রূপে নিযুক্ত করেন। ১৩০৮ সালের ৭ পৌষ এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। হরিচরণ ১৩০৯ সালে যোগদান করেন। ১৩৩৯ সাল পর্যন্ত, তিন দশকের বেশি সময় জুড়ে তিনি এখানে অধ্যাপনা করেছেন।

শিক্ষকতায় একনিষ্ঠতা এবং সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে গুরুদেব তাঁকে অভিধান রচনায় অনুপ্রাণিত করেন। যার ফসল -‘ বঙ্গীয় শব্দকোষ।’ কাজের অগ্রগতি দেখে ব্ন্ধুবর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন – ‘গ্রন্থ খানি রচিত ও প্রকাশিত হইলে দেশের একটি মহৎ অভাব দূর হইবে’। গুরুদেবের নির্দেশে বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ভাষাচার্য্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই কাজে হরিচরণকে ধারাবাহিক সাহচর্য্য দান করেছেন। কিন্তু অভিধানের কাজ শেষ হওয়ার পর উপযুক্ত প্রকাশকের সন্ধানে ব্যর্থ হয়ে হতাশায় একসময় মনোবল হারিয়ে ফেলেন হরিচরণ। “মনে হইল কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর সত্যই বলিয়াছেন – হা ভাতে যদ্যপি চায়, সাগর শুকায়ে যায়। ” খেদোক্তি করেন তিনি ।

আর্থিক অনটনের জন্য বিশ্বভারতী এই বিশাল দায়ভার নিতে পারেনি। যদি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করে , সেই আশায় আচার্য্য দীনেশচন্দ্র সেনের সংগে যোগাযোগ করা হয়। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পাণ্ডুলিপি দেখে কাজের প্রশংসা করেন স্বয়ং। কিন্তু মুদ্রণের আশ্বাস মেলেনা। প্রায় নয় বছর কাটে যন্ত্রণায়। তবে এই সময়কালে মরিয়া হরিচরণ বসে থাকেননি। ক্রমাগত পরিবর্তন, পরিমার্জন ও শব্দ- সংযোজনের কাজ অব্যাহত রাখেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁরাও অর্থাভাবে প্রকাশনার দায়ভার নিতে অপারগ হন।

এগিয়ে এলেন অসুস্থ নগেন্দ্রনাথ বসু। পূর্ব পরিচিত নগেন্দ্রনাথের বাড়িতে ১৩৩৯ সালের গরমের ছুটিতে দেখা করেন হরিচরণ। তিনি আশ্বাস দেন -” এখন আপনি কাগজের দাম দিন ছাপা খরচ ক্রমে ক্রমে দেবেন “। দরিদ্র ব্রাহ্মণের শেষ সম্বলটুকু দিয়ে সারস্বত সাধনা শুরু হয়। ১৩৩৯ সালের চৈত্র মাসে প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। ৫০ খণ্ড প্রকাশের পর নগেন্দ্র নাথের প্রয়াণে কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকে। শেষে এই বিশ্বকোষের কম্পোজিটার মন্মথলাল মতিলালের সহায়তায় প্রতাপ ঘোষের শাংকো প্রেসে বাকি ৫৫ খণ্ড মুদ্রিত হয়। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ৭ ফাল্গুন এই কাজ শেষ হয়। শেষ খন্ডটি প্রকাশিত হয় ১৩৫২ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে।

অর্থাভাবে সরাসরি মুদ্রণের দায়িত্বভার না নিলেও ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ বিপণনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে বিশ্বভারতী এবং রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গীয় পাঠক সমাজের কাছে অভিধান রচনা সাঙ্গ হলে তিনি লিখিত আবেদন পত্র পেশ করেন — শ্রীযুক্ত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় গত বিশ বছর ধরিয়া বাংলা অভিধান রচনায় নিযুক্ত আছেন । সম্প্রতি তাঁহার কার্য সমাপ্ত হইয়াছে। এরূপ সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ অভিধান বাংলায় নাই। ….. বাংলা দেশের পাঠক সাধারণ এই কার্যে অনুকূল্য করিয়া বাংলা সাহিত্যের গৌরব বৃদ্ধি করিবেন, একান্ত মনে ইহাই কামনা করি ।”

কোনো কমিশন ছাড়াই বিক্রির ব্যবস্থা করেন বিশ্ব ভারতী কর্তৃপক্ষ। এগিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী সংসদ এবং অাশ্রমিক সংঘ। তাছাড়া যৌবনে কলকাতায় নাড়াজোলের রাজকুমার দেবেন্দ্রলাল খানের গৃহ শিক্ষক ছিলেন হরিচরণ। সেই রাজকুমারও খবর পেয়ে গুরুদক্ষিণা হিসেবে পাশে থেকে আর্থিক দায়ভার অনেকখানি লাঘব করেন। রবীন্দ্রনাথের সুপারিশে কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী এই কাজে তেরো বছর ধরে মাসিক ৫০ টাকা বৃত্তি প্রদান করেছেন। এইভাবে নানা পথে মুদ্রণ ব্যয় সংগৃহীত হয়। তবে হরিচরণের মৃত্যুর পর ১৯৬৬- ৬৭ সালে দুই খণ্ডে এই বিশাল অভিধান প্রকাশ করে সাহিত্য আকাদেমি। বাঙালির ভাষা চর্চার সোপান সাকার লাভ করে।

‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ আদর্শ অভিধান। প্রমথনাথ বিশী অভিধানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন – “বর্ণানুক্রমিক ভাবে সজ্জিত সরল শব্দের দুরূহ অর্থ সমন্বিত স্থূলকায় গ্রন্থ বিশেষ।” বাংলা অভিধানের গুরুত্ব বিচারে জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস ও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর অভিধান দুটিই সর্বজন নন্দিত। তবে ধারে ও ভারে হরিচরণের সংকলন অনেক বেশি গভীর। কী আছে এর অভিনবত্ব ? গবেষকগণ বিশ্লেষণ করেছেন –
১। প্রাচীন ও আধুনিক মিলিয়ে পূর্ববর্তী ৫০ টিরও বেশি গ্রন্থের শব্দরাজি এখানে সংকলিত। খনার বচন, ডাকের বচন সহ ।
২। ইতিমধ্যে প্রকাশিত সুবল চন্দ্র মিত্রের সরল ‘বাঙ্গালা অভিধান’ (১৯০৬) এবং রজনীকান্ত বিদ্যাবিনোদের ‘বঙ্গীয় শব্দসিন্ধু’ (১৯০৭), বিদ্যাসাগরের শব্দ সংগ্রহ ,বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ‘শব্দমালা’ এবং প্রকৃত ব্যাকরণ থেকে অনেক বাংলা শব্দের মূল সংস্কৃত শব্দ ও তদ্ভব শব্দ এখানে লিপিবদ্ধ হয়।
৩। শব্দগুলির ব্যুত্পত্তি প্রথমে নির্ণয় করা হয়েছে।
৪। প্রথমে মৌলিক ও ধাতুগত অর্থ পরে শব্দটির সাধারণ অর্থ প্রকাশিত।
৫। অর্থ নির্ণয়ের পর সাহিত্যিক নিদর্শন সংযোজিত হয়েছে ।
৬। প্রতিটি শব্দের পদ পরিচিতি সংযোজিত।
৭।সংস্কৃত শব্দের পাশাপাশি অসংস্কৃত শব্দের উত্পত্তি ও যথাসম্ভব নিদর্শিত হয়েছে।
অভিধান রচনার ফাঁকে ফাঁকে হরিচরণ আরও কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্কৃত প্রবেশ, পালিত প্রবেশ, ব্যাকরণ কৌমুদি, কবির কথা, রবীন্দ্রনাথের কথা। Hints of Sanskrit Translation and Composition ইত্যাদি। তবে তাঁকে ভাষা শিক্ষার ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয় করেছে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। বাংলার বিশিষ্ট মনীষীগণ তো আছেনই । মহাত্মা গান্ধী তাঁর প্রশংসা করে লিখেছেন — a work with entitles him to be ranked with gaints like shri Nagendranath Bose, the author of bengali VisvaKosha and Professor Murray of Oxford University fame .(০৯/০৩/১৯৪০ হরিজন পত্রিকা) ।

১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ মাসিক ৭৫ টাকা বৃত্তি মঞ্জুর করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করে সরোজিনী বসু স্বর্ণ পদক (১৯৪৪) এবং শিশির কুমার স্মৃতি পুরস্কার (১৯৫৪)। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৭ সালে ডি. লিট. ও দেশিকোত্তম প্রদান করে আচার্য্য জওহরলাল নেহেরুর পৌরোহিত্যে। নানা পুরস্কারে অলঙ্কৃত মানুষটি শেষ জীবনে প্রায় অন্ধ হয়ে যান। তবু কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করতে ভোলেননি রবীন্দ্র -অবদান: “গুরুদেবের নির্দিষ্ট কাজে চোখ দুটো উৎসর্গ করতে পেরেছি, এটাই পরম সান্ত্বনা” ।

- Advertisement -
Latest news
Related news