Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১০২।। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

কালজয়ী কথাসাহিত্যিক
তারাশঙ্কর বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

“কালো যদি মন্দ তবে
কেশ পাকিলে কান্দ কেন” ?
জনপ্রিয় এই পল্লীগীতির কথাকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বঙ্কিম – রবীন্দ্র – শরৎচন্দ্র পরবর্তী বাংলা গল্পে অনন্য মাত্রা দান করেছেন তিনি।

জন্মেছিলেন লাভপুর ,বীরভূমে (২৩.০৭.১৮৯৮ — ১৪.০৮. ১৯৭১)। শৈশবে হারান বাবা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের সন্তান। মা প্রভাবতী দেবী। লাভপুর যাদবলাল বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে চলে আসেন কলকাতায়। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে প্রথমে , পরে ভর্তি হন সাউথ সাবার্বান কলেজে। গান্ধিজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিছুদিন জেলে কাটান। ১৯৩০ এ ।

ছেলেবেলায় ধর্মপরায়ণ বাবা ও ভক্তিময়ী মায়ের প্রেরণায় শরীরে ধারণ করতে হয়েছে মাদুলি ,তাবিজ, কবচ। নিয়মিত মন্দিরে পুজো অর্চনায় অংশ নিয়েছেন। যৌবনে এই নিয়ে কম মানসিক টানাপোড়েনে ভুগতে হয়নি। ধীরে ধীরে সংস্কারমুক্ত প্রগতি পথের পথিক হয়েছেন তারাশঙ্কর।

তথ্যের আলোয় উদ্ভাসিত তারাশঙ্করের উপন্যাসের সংখ্যা ৬৫। গল্পের সংকলন ৫৩টি। লিখেছেন ১১টি নাটক। এছাড়াও ৪টি প্রবন্ধ গ্রন্থ, ৪টি আত্মজৈবনিক রচনা এবং ২টি ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন তিনি। প্রকাশিত হয়েছে ‘ত্রিপত্র’ কবিতা সংকলন। সাহিত্য জীবনের গোড়ায়।

সংবেদনশীল কথা সাহিত্যিক হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করলেও নাটক ছিল তাঁর প্রথম প্রেম। বাস্তবে লাভপুরের মাটি ,ঝুমুর, বাউল ,কবিলড়াই শুনে বেড়ে ওঠা তারাশঙ্কর ছিলেন অাদ্যন্ত নাট্যপাগল। সেকালে কলকাতায় পেশাদার নাটকে অভিনেত্রীদের স্বচ্ছন্দ পদচারণা শুরু হলেও মফসসলে – গ্রামে কিংবা ছোট শহরে পুরুষরাই স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করতেন। লাভপুরের অতুলশিব মঞ্চে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন তারাশঙ্কর।
স্কুল জীবনে একটি ব্রিটিশ বিরোধী নাটকে মঞ্চে আবির্ভাব তাঁর। তবে ব্রিটিশ বন্ধু
সামন্ত জমিদার বংশের সন্তান হয়ে এজাতীয় স্খলন বাড়ির লোকেরা সহজে মেনে নেননি। তিরস্কৃত হয়েছেন। মোলায়েম মুখ ও ছিপছিপে চেহারার জন্য যেকোনো নারী চরিত্রে অবলীলায় মানিয়ে যেত তাঁকে। পৌরাণিক নাটক ‘সীতা’ যখন মঞ্চস্থ হয় নাম ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেন। জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এলাকায়। এছাড়া ‘গৃহলক্ষ্মী’ নাটকে মেজবউ, ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে কল্যাণী , চাঁদবিবি নাটকে মরিয়ম এবং ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ নাটকে ‘বিনোদিনী’ চরিত্রে অভিনয় করে সারা বীরভূম বর্ধমান এলাকায় অভিনয় প্রতিভায় বহু দর্শকের দ্বারা অভিনন্দিত হন।

শুধু অভিনয় নয় , নাটক লেখায় আনন্দ পেতেন দেদার। ‘ইতিহাস ও সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে কবুল করেছেন “.. .. .. অভিনয় ভালো লাগে ,নাটক রচনা করি সে রচনা অবশ্য তখন solitary pride এর সামিল আমার কাছে “। লিখেছেন একটি পঞ্চাঙ্ক -‘ মারাঠা তর্পণ’ ।বীরভূমের খ্যাতনামা নাট্যকার ও পরিচালক নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায় নাটকটির পাণ্ডুলিপি চেয়ে নিয়ে কলকাতায় পেশাদার মঞ্চে মঞ্চায়নের লক্ষে জমা দেন অপারেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি তা না পড়েই ফেরত পাঠিয়ে দেন। সেই দুঃখে ও অভিমানে পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলেন তারাশঙ্কর। নাটক লেখা ছেড়ে গল্পের পথে পাড়ি জমান।

তাঁর কাহিনি রাইকমলে মুগ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ। নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়িকে অনুরোধ করেন মঞ্চায়নের। শিশিরবাবুর কথায় নাট্যরূপ দেন তারাশঙ্কর । নানা জটিলতায় তা মঞ্চস্থ হয়নি। পরে রংমহল ‘দুইপুরুষ’ অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, কিছুদিন মহলা হলেও মঞ্চে ওঠেনি। ১৯৪১ সালের ১২ জুলাই প্রথম ‘নাট্যনিকেতন’ মঞ্চস্থ করে তাঁর নাটক কালিন্দী। এই নাটকের গীত রচনা ও আবহ সংগীত প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। চল্লিশ থেকে ষাটের দশকে একে একে বহু মঞ্চ সফল নাটক সৃষ্টি করেছেন তিনি। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সাথেও যুক্ত হয়েছেন সেই সূত্রে।

১৯৩২ সালে প্রথমবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করেন তারাশঙ্কর। এই বছরেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’। বাংলা সাহিত্যে অসীম বিস্ময়ের জগৎ সৃষ্টি করেছেন তিনি। গণদেবতা , জলসাঘর , কবি , হাঁসুলীবাঁকের উপকথা , কালিন্দী ,পঞ্চগ্রাম, ধাত্রীদেবতা , আরোগ্য নিকেতন, অভিযান , সন্দীপন পাঠশালা, নিশিপদ্ম , মঞ্জরী অপেরা তাঁর অনুপম সংযোজন।

গল্পকার হিসেবেও সমান খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি। প্রতিটি গল্প গ্রাম জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার নাটকীয় অভিঘাতে পরিপূর্ণ। ১৯৩৭ সালে প্রথম ছলনাময়ী গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। তিন কন্যা, বেদেনী , যাদুকরী , হারানো সুর, তাঁর কয়েকটি নিদর্শন মাত্র। সমাজের অন্ত্যজ দলিত অংশের মানুষজন রক্ত মাংসের অবয়ব ও প্রেম-হিংসা -হর্ষ -রিরংসা নিয়ে ধূলি ধূসরিত জীবন থেকে উঠে এসেছে সাহিত্যের পাতায়। বেদে, মালাকার ,লেঠেল ,কবিয়াল বাগদী ,বোষ্টমী ,পটুয়া , চৌকিদার নানা পেশার রংমহল সৃষ্টি করেছে। তাই চলচ্চিত্র পরিচালকগণ বার বার তাঁর কাছে কাহিনির জন্য স্মরণাপন্ন হয়েছেন।

১৯৪০ সালে কলকাতার বাগবাজারে সপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ভাড়া বাড়িতে। ১৯৪৮ সালে টালাপার্কে বাড়ি বানিয়ে চলে যান। রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও রাজনীতির লোকজন বরাবর সক্রিয় ছিলেন তাঁকে নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানপরিষদের সদস্য হয়েছেন। হয়েছেন রাষ্ট্রপতি মনোনীত সাংসদও। ১৯৪২ এর উত্তাল সময়ে ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৫৭ সালে চীন সফরে গেছেন। ১৯৫৮ সালে আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে ভারতীয় দলনেতা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দিয়েছেন। দীর্ঘদিন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি পদে বৃত ছিলেন ।

১৯৬২ সালে একটি পারিবারিক দুর্ঘটনায় অবসাদগ্রস্ত হন। তাঁর বড় জামাই শান্তিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় এর মৃত্যু হয়। অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে হাতে তুলে নেন রং ও তুলি। ছবি আঁকেন। কাঠের পুতুল বানানো শুরু করেন।

নিজের জন্মস্থান লাভপুরের মানুষের দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে বার বার সম্মানিত হয়ে অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন লেখক। এছাড়াও বাংলা ও ভারতের নানা প্রান্তে নানা সাহিত্য সমাবেশে বহুবার সংবর্ধিত হয়েছেন। তাঁর আজীবন সাহিত্যকৃতির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করেছে শরৎস্মৃতি পুরস্কার (১৯৪৭) এবং জগত্তারিণী স্বর্ণ পদক (১৯৫৭)।

এছাড়াও তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫৫), সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার (১৯৫৬), জ্ঞানপীঠ পুরস্কার(১৯৬৭) অর্জন করেন। ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেছে পদ্মশ্রী (১৯৬২) এবং পদ্মভূষণ উপাধি(১৯৬৯) ।

আধুনিক গবেষকগণ অনেকেই তাঁকে রাঢ়বাংলার কথাকার হিসেবে , প্রথম সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাসের রূপকার হিসেবে চিন্হিত করেছেন। কিন্তু তাঁর সার্বিক মূল্যায়ণ করতে গিয়ে তাঁকে খণ্ডিত দেখানো হয়। ভাবীকালের গবেষকগণ তাঁকে তাঁর সমসময়ের অখণ্ড কালপর্বে নতুনভাবে মূল্যায়ণ করবেন,সেই প্রত্যাশায় বাঁচি ।

- Advertisement -
Latest news
Related news