Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১০০।। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

সুরসম্রাট
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

“সঙ্গীত আমার জাতি , সুর আমার গোত্র “- এই অসাধারণ বাণীকে জীবনে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে সুর সাধক তাঁর নাম- ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (০৮.১০.১৮৬২ — ০৬.০৮. ১৯৭২)। জন্মেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবেড়িয়ায়। তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার নবীন নগর থানার শিবপুর গ্রামে। বাবার নাম সবদর হোসেন খাঁ (সদু খাঁ ), মা – সুন্দরী বেগম। দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কৈশোর ছিল বর্ণময়। দশ বছর বয়সে গান বাজনার টানে ঘর ছাড়েন। যাত্রা দলে নাম লেখান। গান শোনান। তাদের সাথে ঘুরে ঘুরে ঢাকায় যান। সেখান থেকে কলকাতায়।

ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর এই ‘নওল কিশোরকে’ ফুটপাত থেকে তুলে সেকালের বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কাছে নিয়ে যান এক সহৃদয় মানুষ। এখানে বারো বছর সরগম সাধনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন আলম (ডাকনাম )। কিন্তু সাত বছরের মাথায় নুলো গোপালের মৃত্যু হলে আবার ঠাঁইনাড়া হন তিনি। এদিকে বাড়িতে আকুল মা। মেজদা এসে ধরে নিয়ে যান গ্রামে। সংসার ধর্মে যুক্ত করবার আশায় বিয়ে দিয়ে দেন মদিনা বিবির সাথে। কথিত আছে, বিয়ের রাতে ঘুমন্ত স্ত্রীকে ত্যাগ করে পথে নামেন গানপাগল মানুষটি ।
পরে ময়মনসিংহের মুক্ত গাছার রাজার দরবারে ওস্তাদ আহমেদ আলী খানের কাছে সরোদ শিক্ষা নেন। সেখান থেকে মধ্যপ্রদেশের মাইহারে যান। থিতু হন। এখানে স্ত্রী মদিনা বিবিকে নিয়ে যান (১৯১৮)। বাড়ি করেন। নাম রাখেন মদিনা ভবন।

তার আগে কলকাতায় স্টার থিয়েটারে অমৃতলাল দত্তের কাছে (হাবু দত্ত) বেহালায় তালিম নেন। এই হাবু দত্ত একদিন নিয়ে যান মিনার্ভায়। সেখানে নাট্যাচার্য্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের সান্নিধ্যে নাটকের সহকারী সঙ্গীত পরিচালক নিযুক্ত হন এবং বাদ্যযন্ত্র গুলিকে যত্ন নেবার দায়িত্ব পালন করেন। ক্লান্তিহীন ভাবে সুদীর্ঘ জীবন শুধু সংগীতের তালিম নিয়েছেন। তাঁর অগণন গুরুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পূর্বোক্তরা বাদে কয়েকজন হলেন – তান সেনের বংশধর ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ, ওস্তাদ আহমেদ আলী খাঁ, লবো সাহেব, মিসেস লবো (গোয়ানিজ দম্পতি ), হাজারি ওস্তাদ , নন্দবাবু প্রমুখ। তবে সঙ্গীতের হাতে খড়ি নিজের বড় ভাই সাধক ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁর কাছে। উল্লেখ্য, তাঁর ছোট ভাই ওস্তাদ আয়েত খাঁ ও ছিলেন সেকালের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ।

কণ্ঠসঙ্গীতে তালিমের পাশাপাশি যন্ত্রসংগীতের প্রতিও তাঁর আকর্ষণ ছিল চুম্বকের মতো। যেখানে যা পেয়েছেন , আয়ত্ত না করে ছাড়েননি। অনায়াসে যে যে বাদ্য যন্ত্রে মগ্ন হতেন – তার সম্পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত করা অসম্ভব কাজ। সেতার, সানাই, সরোদ , বেহালা ( যার ইংরেজি নাম ভায়োলিন, ওস্তাদ আলাউদ্দিনকৃত নাম বাহুলীন ) বাঁশি , সুরবাহার , মৃদঙ্গ , তবলা , পাখোয়াজ , কর্নেট , বেহালা , নাকাড়া , টিকারা, জগঝম্প , বীণা পিকলু, স্যাক্সোফোন, ট্রামপেট, ক্ল্যারিয়োনেট , ফিডল , ব্যাঞ্জো, ম্যান্ডোলিন এবং হারমোনিয়ামে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। নিজে দুটি অসাধারণ বাদ্যযন্ত্র সৃষ্টি করেছেন – চন্দ্রসারং ও সুরশৃঙ্গার ।

বাংলার জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, যাত্রা, কীর্তন যে সুরের জমি তৈরি করেছিল তার সাথে যুক্ত হয় মার্গসঙ্গীতে তালিমের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। রাগনির্ভর গানগুলিতে ‘আলম’ ভণিতা ব্যবহার করেছেন। অসংখ্য যুগান্তকারী রাগ রাগিনীর সৃষ্টি করেছেন- ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তার মধ্যে প্রাতঃকালীন দুটি বিখ্যাত রাগ মদনমঞ্জরী এবং ভুবনেশ্বরী স্ত্রী মদিনা বিবিকে উৎসর্গ করেছেন। ভ্রাতুষ্পুত্র মোবারক হোসেন খাঁয়ের অনুরোধে সৃষ্টি করেছেন প্রাতঃকালীন রাগ মোহাম্মদ। সান্ধ্য রাগ শোভাবতী, ধবলশ্রী, গভীর রাত্রির রাগ হেমবেহাগ , রাত্রিকালীন কাফি ঠাটের রাগ সরস্বতী তাঁর অনুপম সৃষ্টি। এছাড়াও হেমন্ত , দুর্গেশ্বরী , মেঘবাহার , প্রভাতকেলী, ধনকোশ , রাজেশ্রী চণ্ডিকা, দীপিকা, মলয়া, মান্ঝা খাম্বাজ , কেদার মান্ঝা প্রভৃতি রাগরাগিনী তাঁকে সংগীতের মহামণ্ডলে অমরত্ব প্রদান করেছে।

স্বরলিপি নির্মাণে সিদ্ধহস্ত মানুষটির বহুগানের স্বরলিপি সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা গ্রন্থে নিয়মিত প্রকাশিত হত। তাঁর সঙ্গীত সাধনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হল নৃত্যাচার্য্য উদয় শংকরের সাথে ১৯৩৪ সালে বিশ্ব পরিক্রমা। ইংল্যান্ডের রানী এই সময় তাঁর সুরের মায়ায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সুরসম্রাট খেতাব প্রদান করেন। ইউরোপ থেকে ফিরে এসে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দুমাস শান্তিনিকেতনে সঙ্গীতের অধ্যাপনা করেছেন দিনেন্দ্র অধ্যাপক পদে।

১৯২৫ সালের ১১ জানুয়ারি লক্ষ্ণৌতে শুরু হয় তিনদিনের ফোর্থ অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স। এখানে বেহালায় কাফি আর তিলক কামোদ পরিবেশন করেন আলাউদ্দিন। তবলায় সঙ্গত করেন বারাণসীর প্রখ্যাত শিল্পী বীরু মিশ্র। রসভিজ্ঞ মহলের অপার মুগ্ধতায় কনফারেন্সের শেষদিনে পুনরায় মঞ্চে আবির্ভূত হতে হয় তাঁকে। পরিবেশন করেন গারা ও দরবারি কানাড়া। তবলায় যুগলবন্দী ছিলেন খালিফা আবিদ হোসেন। তাল- লয়কারির মারপ্যাঁচে যে সুর-সংঘর্ষ শুরু হয় তা বন্ধ করতে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসেন লক্ষ্ণৌর রাজা নবাব আলি ঠাকুর এবং পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে। এরপর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘খাঁ সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করে
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মাইহার ঘরানাকে পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা দান করেছেন তাঁর পুত্র আলী আকবর খাঁ (সেতার ), কন্যা অন্নপূর্ণার স্বামী পণ্ডিত রবিশংকর। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের জীবনী ‘আমার কথা’ তাঁর সম্পূর্ণ জীবনকথা না হলেও সঙ্গীতের প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে অবশ্য পাঠ্য। সংকল্প, ধৈর্য্য, নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা একটি মানুষকে কোন উচ্চতায় সমাসীন করতে পারে – তার আঁচ ও উষ্ণতা এই গ্রন্থ থেকে অনুভব করা যায়। এই গ্রন্থের একটি মূল্যবান ভূমিকা লিখেছেন পণ্ডিত রবিশংকর।

তাঁর উল্লেখযোগ্য শিষ্যরা হলেন- তিমিরবরণ, ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর হোসেন খাঁ, কন্যা রওশন আরা বেগম (অন্নপূর্ণা), ফুলঝুরি খান, খাদেম হোসেন খান, মীর কাশেম খাঁ, পৌত্র আশিস খাঁ ও ধ্যানেশ খাঁ ,খুরশীদ খাঁ , নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় , পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য্য , পান্নালাল ঘোষ, শারনরানী , ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য্য , দ্যুতিকিশোর আচার্য্য চৌধুরী, শচীন্দ্রনাথ দত্ত , রাজা ব্রিজ নারায়ণ , শ্রীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, যামিনী কুমার চক্রবর্তী এবং সন্তোষ প্রামাণিক প্রমুখ দিকপাল শিল্পী।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ভারতবর্ষে প্রথম দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে অর্কেস্ট্রার স্টাইলে ‘রামপুর স্টিং ব্যান্ড’ নামে যন্ত্রীদল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর আরেক অনন্য সৃষ্টি মাইহার কলেজ অব মিউজিক। কেবলমাত্র সঙ্গীতে নিবেদিত প্রাণ ছাত্রছাত্রীরা কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তালিম নিতে এখানে ভর্তি হতে পারেন।

দিল্লী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি. লিট সম্মান জ্ঞাপণ করেছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করেছে দেশিকোত্তম (১৯৬১) সম্মান। সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছেন (সরোদ ১৯৫২)। পদ্মভূষণ (১৯৫৮) এবং পদ্ম বিভূষণ (১৯৭১) সম্মান প্রদান করেছে ভারত সরকার ।

লালন ফকিরের মতো দীর্ঘায়ু ছিলেন তিনি। বাস্তবিক অর্থেই একটি শতক জুড়ে বিশ্বকে সুরের মায়ায় আবিষ্ট রেখেছিলেন। তাঁর জীবন ও সৃষ্টি সারস্বত সাধনায় চারণরত যেকোনো সাধকের কাছে চিরশিক্ষণীয়।

- Advertisement -
Latest news
Related news