Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৭৭।। মদনমোহন তর্কালঙ্কার।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

বিস্মৃতপ্রায় পণ্ডিত
মদনমোহন তর্কালঙ্কার

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

বিনোদ মন্ডল

ঊনবিংশ শতকের বঙ্গদেশে, নব জাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মদনমোহন তর্কালঙ্কার (০৩ জানু ১৮১৭ — ৯ মার্চ ১৮৫৮)। তিনি ছিলেন সংস্কৃতিজ্ঞ পণ্ডিত, শিক্ষা প্রসারক, সমাজ সংস্কারক। দক্ষ প্রশাসক এবং সেকালের জনপ্রিয় কবি ।
‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল’ তাঁর অমর সৃষ্টি। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি / সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’ জাতীয় মৌলিক ভাষ্য একুশ শতকের শিশুদেরও চরিত্র গঠনে ও মূল্যবোধ জাগৃতিতে সমান প্রাসঙ্গিক পংক্তিমালা।
নদীয়া জেলার নাকাশিপাড়ার বিল্বগ্রামে জন্ম। বাবা – রামধন চট্টোপাধ্যায়। মা – বিশ্বেশ্বরী দেবী। বাবা সংস্কৃত কলেজের লিপিকর ছিলেন। বিদ্যারত্ন উপাধিতে ভূষিত হন। স্বভাবতই মদনমোহনকে ভর্তি করেন সংস্কৃত কলেজে। সেখানেই সহাধ্যায়ী ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। সেই সুবাদে দুজনের আন্তরিক সখ্য আজীবন পাথেয় ছিল মদনমোহনের। ১৮২৯ সাল অগ্নিগর্ভ সময়। কলকাতায় তখন ডিরোজিও ঝড়। তখন দেখা হলো দুজনের।

ডিরোজিও’র প্রিয় ছাত্র রামতনু লাহিড়ীর বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করেন মদনমোহন। স্বভাবত:ই জড়িয়ে যান ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনে। সংস্কারমুক্ত মনে জেগে ওঠে সমাজ সংস্কারের ভাবনা। হিন্দু বিধবা বিবাহ প্রচলনে ঈশ্বরচন্দ্রকে সক্রিয় সহযোগিতা করেন তিনি। ১৮৫৭ সালে প্রথম বিধবা বিবাহ সংগঠিত হলো বাংলাদেশে। সেই ঐতিহাসিক ঘটনায় জড়িয়ে আছেন মদনমোহন। কেননা বিয়ের পাত্র শ্রীশচন্দ্র এবং পাত্রী কালীমতিকে সন্ধান ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সূত্রধরের ভূমিকা ছিল তাঁর।

নিজের কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতা দিয়ে। ১৮৪২ সালে হিন্দু কলেজের পাঠশালার প্রধান শিক্ষক হন তিনি। ১৮৪৬ সালে নদীয়ার রাজা শ্রীশচন্দ্রের আর্থিক সহায়তায় স্থাপিত হয় কৃষ্ণ নগর কলেজ। এখানেও সংগঠকের ভূমিকায় মদনমোহন। সকলের অনুরোধে প্রথম পর্যায়ে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন এই কলেজে। এবছরই বিদ্যাসাগরের ডাকে সাড়া দিয়ে যুক্ত হন সংস্কৃত কলেজে, অধ্যাপনায়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজেও অধ্যাপনা করেছেন।
১৮৫০ –১৮৫৪ সাল নাগাদ মুর্শিদাবাদের জর্জ পণ্ডিত পদে বৃত হন। বিচারকের চাকরি করতে গিয়ে শিক্ষা প্রসারের ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি কখনো। বহরমপুরে কলেজ স্থাপনে হিতৈষী বন্ধুদের সংগে ঝাঁপিয়ে পড়েন, সফল হন। পদোন্নতি হয় মদনমোহনের। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তখন। প্রশাসক থাকাকালীন মুর্শিদাবাদ ও কান্দিতে চালু করেন দাতব্য চিকিৎসালয়। মেয়েদের স্কুল। শহরের রাস্তাঘাট নির্মাণে নিরলস দৃষ্টি ছিল তাঁর।

বেথুন সাহেব কলকাতায় একটি স্কুল শুরু করেন। ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’। সেখানেও অন্যতম প্রধান সহকারী মদনমোহন। বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষকতা করেছেন। বাড়ির মেয়েদের শিক্ষাঙ্গনে টেনে আনতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে নিজের দুই মেয়ে ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে ভর্ত্তি করেন এই স্কুলে।

‘স্ত্রীশিক্ষা’ গ্রন্থ প্রণেতা মদনমোহন তখনই অনুভব করেন -‘ শিশুকে শিক্ষিত করতে গেলে মায়েরই শিক্ষা আগে দরকার।’ বিশ শতকের শেষে পশ্চিমবাংলায় সাক্ষরতা আন্দোলনে ফরাসী দার্শনিক ‘দিদেরো’ র একটি বাণী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যার বাংলা তরজমা হলো ‘সাক্ষর মায়ের সন্তান কখনও নিরক্ষর হয় না।’ কি আশ্চর্য! একই কথা তাঁর বহু বছর আগে আমাদেরই এক মনীষী বলে গেছেন, প্রচারের আলোয় আসেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেকালের পরিচিত সাময়িক পত্র ‘সর্বশুভকরী’ তে স্ত্রীশিক্ষার সপক্ষে একটি অনবদ্য প্রবন্ধ রচনা করেন তিনি (১৮৫৩)।
বহু প্রচলিত প্রবাদপ্রতিম বাক্য ‘লেখা পড়া করে যে /গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’ আজকের দিনে বেকারত্বের যুগে হয়তো ক্লিশে মনে হয়। কিন্তু সেকালে এই সুভাষণ মানুষের শিক্ষা নিয়ে জড়তা কাটাতে অসম্ভব উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। শিশুপাঠ্য ‘শিশুশিক্ষা’ বইটির জনপ্রিয়তা ছিল অপরিসীম। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের আগে এই প্রয়াস, মনে রাখা দরকার। বইটির প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়।

এই শিশুশিক্ষা পড়েছেন রবীন্দ্রনাথও। শৈশবে। রবিজীবনীতে আছে -“রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আরম্ভ হয়েছিল মদনমোহনকৃত শিশুশিক্ষা দিয়ে এবং তারপরে সম্ভবত বর্ণপরিচয়ের সংগে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল।” ১৮৫০ এর মধ্যে বইটির তৃতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। তাই, এই গ্রন্থটিকে বাঙলার প্রথম ‘প্রাইমার’ অভিধাতে অভিহিত করা হয়।
অসাধারণ মননশীল মানুষটি যখন ছাত্র, তখনই লিখে ফেলেন দু’ খানি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ – বাসবদত্তা এবং রাজ তরঙ্গিনী। তাঁর আমার পণ লেখাটি আজকের বাংলাদেশে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তে হয়। তাঁর স্বাদু রচনারীতি সময়ের তুলনায় ঈর্ষণীয় ভাবে এগিয়েছিল। সাহিত্য সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দেননি। শিশুদের মেজাজ ও মানসিকতাকে ভাবনায় রেখে অক্ষর সাধনা করেছেন তিনি। সময়ের দাবি মেটাতে ১৪টি সংস্কৃত গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন প্রশাসনিক ব্যস্ততার মধ্যেই।
কান্দিতে থাকবার সময় কলেরাতে আক্রান্ত হন। তখন যা ছিল দুরারোগ্যপ্রায়। অকালে চলে যেতে হয় সদ্য চল্লিশ উত্তীর্ণ অসামান্য কর্মযোগী মানুষটিকে। যাঁকে দুই বাংলার মানুষ আজ বিস্মৃতপ্রায়।

- Advertisement -
Latest news
Related news