Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৫২: লেডি অবলা বসু।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

অবলাবান্ধবী
লেডি অবলা বসু                               বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। একটি লোমহর্ষক খবর মুচ মুচে পাঁপড়ের মতো মুখে মুখে রটে – একেবারে যারপরনাই ভাইরাল হয়ে গেল। বরিশালের এক উকিল ব্ন্ধুদের সাথে যোগসাজশে নিজেরই এক বন্ধুর সাথে আপন বিধবা বিমাতার বিবাহ ঠিক করেছেন। এবার বিমাতার আত্মীয় স্বজনরা এই খবর জানতে পেরে তড়িঘড়ি তাকে গোপনে কাশীতে পাঠিয়ে দিল। কিন্তু বিমাতা গোপনে সপত্নীপুত্রকে জানিয়ে গেলেন, তিনিও তাঁর ঐ বন্ধুর প্রতি অনুরক্তা। এবার ছায়াছবির কায়দায় তাঁকে কাশী থেকে উদ্ধার করে বরিশালে আনা হলো। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সক্রিয় সহায়তায় সম্পন্ন হলো এক ঐতিহাসিক বিধবাবিবাহ। এই ঘটনার অভিঘাতে প্রবল আর্থিক ও সামাজিক নিপীড়নের শিকার হন ঐ উকিল ও সমাজ সংস্কারক দুর্গামোহন দাস। লেডি অবলা বসু তাঁরই সুযোগ্য দ্বিতীয়কন্যা ও বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসু (০৮-০৮- ১৮৬৫ — ২৪-০৪- ১৯৫১)।

প্রবল সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বরিশালের পাট চুকিয়ে ১৮৭০-৭১ সালে কলকাতায় চলে আসেন দুর্গামোহন। সস্ত্রীক। এখানে ওকালতির পাশাপাশি অবলাবান্ধব দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহচর্যে শুরু হলো উভয়ের সমাজ সংস্কারের কাজে ডুবে যাওয়া।
স্ত্রী ব্রম্ভময়ী দেবী আবাসিক ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’ এর মেয়েদের কাছে নিজগুণে মাতৃস্থানে অভিষিক্ত হন। এমনই উদার ও সংস্কারপন্হী আবহাওয়ায় বড় হয়েছেন অবলা বসু। বরিশালে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হলেও কলকাতায় এসে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় (পরিবর্তিত নাম বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়) এবং বেথুন স্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৮৮১ সালে এখান থেকেই ২০ টাকা জলপানি পেয়ে এন্ট্রান্স পাশ করেন তিনি। সেখান থেকে বেথুন কলেজ। ইলবার্ট বিল আন্দোলনে কলকাতা তখন উত্তাল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জেলে গেলেন। বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ গর্জে উঠল। তাদের সাথে অবলা বসু, কামিনী রায়,সরলা দেবী চৌধুরানীরা আন্দোলনে অংশ নিলেন।
কলকাতায় তখনও মেয়েদের জন্য মেডিক্যাল কলেজের দ্বার উন্মুক্ত হয়নি। মাদ্রাজে হয়েছে। তবে কলকাতায় আগ্রহী ছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপ চালু হয়েছে। সেই স্কলারশিপ নিয়ে মাদ্রাজে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে গেলেন বেথুন কলেজের এই মেধাবী ছাত্রী। মাদ্রাজে মেয়েদের জন্য তখনও হস্টেল চালু হয়নি (১৮৮২)। একটি খ্রিস্টান পরিবারে পেয়িং গেস্ট হলেন তিনি। ব্রাম্ভ সমাজের নেতা শিবনাথ শাস্ত্রী অবলাকে লিখলেন : “নাবিক সমুদ্রে পোত পাঠাইয়া যে রূপ অপেক্ষা করে, তোমাকে মাদ্রাজে পাঠাইয়া ব্রাম্ভ সমাজ সেই রূপ অপেক্ষা করিতেছে জানিবে।” কিন্তু প্রায় আড়াই বছর পড়াশুনা করার পর বিজ্ঞানসাধক জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হয় তাঁকে, ফলে বাঙালীকে অপেক্ষা করতে হয় কাদম্বিনী পর্যন্ত। প্রথম মহিলা বাঙালি ডাক্তারের জন্য।
ছাত্রী জীবনে ছেদ পড়ার সুনির্দিষ্ট কোন ও কারণ বা তার জন্য পরবর্তীকালে আক্ষেপের কোনো খবর ইতিহাসে নেই। বরং দেখা যায়, জগদীশচন্দ্রের সাধনায় শক্তি জোগানোর কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন তিনি। বহির্বিশ্বে বারবার স্বামীর ছায়াসঙ্গিনী থেকেছেন। আমেরিকা থেকে জাপান সর্বত্র। এমনকি ইউরোপের নানা বিজ্ঞান সভাতেও তিনি জগদীশচন্দ্রের পাশে ছিলেন। তাঁর প্রবাস জীবনের কাহিনী ধরা আছে সেকালের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় এবং পরবর্তীকালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘বঙ্গ মহিলার পৃথিবী ভ্রমণ’ গ্রন্থে । পরশ পাথর প্রকাশনা থেকে -” অবলা বসুর ভ্রমণ কথা নামেও একটি আকর্ষণীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠায় অবলা বসুর অবদান ইতিহাস স্বীকৃত।উল্লেখ্য , ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে নাইট উপাধি লাভ করেন জগদীশচন্দ্র। সেই সুবাদে তিনিও হন লেডি অবলা বসু ।
ব্রাম্ভ মহিলাদের মধ্যে তখন একটা শিক্ষা ও সংস্কারের প্রবণতা শুরু হলেও হিন্দু মহিলাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। ফলে অবলা বসু হিন্দু মহিলাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারকে অগ্রাধিকার দেন। তাঁর মুখ্য ভূমিকায় গড়ে ওঠে ‘হিন্দু মহিলা পরিষদ’।শুধু খাতায় কলমে নয়, মাসে দুবার এই পরিষদের অধিবেশন বসত কলকাতার মেরি কার্পেন্টার হলে। সমসাময়িক আর্থ -সামাজিক – রাজনৈতিক নানা বিষয়ে এই সভা গুলিতে আলোচনা হত। বিভিন্ন ইস্যুতে বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রণ জানানো হত বাংলার প্রখ্যাত ব্যক্তিদের। তথ্য হল: আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, অধ্যাপক এস. সি. মহালানবিশ এমনকি আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুও মহিলা পরিষদের আলোচনা সভায় বক্তব্য রেখেছেন ।

শুধু কলকাতা নয়, মফসসল শহর, এমনকি গ্রামীণ বাংলায় বিশ শতকের প্রেক্ষাপটে নারী শিক্ষা বিস্তারে অতন্দ্র ভূমিকা পালন করেন লেডি অবলা বসু। তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান নারী শিক্ষা সমিতি (১৯১৯) স্থাপন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে মনোনিবেশ করেন। শুধু তাই নয়, মাতৃ ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করে সন্তান সম্ভবা মায়েদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে উদ্যোগ নেন। শিশু পালন, ধাত্রী বিদ্যা, শিশু শিক্ষা, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং গৃহস্থ সেবার নানা দিক নিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মেয়েদের আর্থিক স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে তিনিও কুটির শিল্পে নিবিড় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন ।

১৯২২ সালে ‘বিদ্যাসাগর বাণীভবন ‘প্রতিষ্ঠা করে বিধবা রমণীদের অশ্রমিক জীবনে প্রশিক্ষিত করে শিক্ষিকা শিক্ষনের কাজ শুরু করেন। এরাই প্রশিক্ষিত হয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে পল্লী বালিকাদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো শুরু করে। দেখা যাচ্ছে,১৯২০ সাল থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে ৪০ জন মতো শিক্ষিকা এই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে গ্রামে গ্রামে গিয়ে শিক্ষকতা করেন। তখন তাদের মাসিক বেতন ছিল দশ টাকা। এইভাবে দশ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অর্জিত হলে তাদের পুনরায় প্রশিক্ষণ দানের পর শিক্ষয়িত্রী হিসেবে দেশের নানা প্রান্তে প্রেরণ করা হত । এই ভাবে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত প্রায় একশো জন মহিলা শিক্ষিকার কাজে যুক্ত হন।

বিদ্যাসাগর বাণীভবনের কাজে আকৃষ্ট হয়ে ঝাড়গ্রামের মল্লদেব বংশীয় রাজা এই সমিতিকে ২৫ বিঘা জমি ও দশ হাজার টাকা দান করেন। তা থেকে ঝাড়গ্রামে এক বিধবা আশ্রম স্থাপিত হয়। সেখানে গো-পালন, দুগ্ধ উত্পাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনের উদ্যোগ নেন তিনি। পাশাপাশি উদ্যান চর্চা, বিশেষত: ভেষজ উদ্যান গড়ে তোলা হয়। পরে এলাকার সাথে সাযুজ্য রেখে এখানে রেশম শিল্পকে পাঠ্য তালিকা ভুক্ত করা হয়।
১৯১০ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত ব্রাম্ভ বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদিকা ছিলেন তিনি। তাঁর দিদি সরলা রায়ও কম যান না৷ তিনি গড়ে তোলেন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান – গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল। একাজে দিদিকে সহায়তা করেছেন তিনি। একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছেন -” আপনি অবসরমতো স্কুলের মেয়েদের জন্য যদি কোনরূপ লেখা লিখিয়া দেন তাহা হইলে উপকার হয়….!”
একালে যখন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে নানা প্রকল্পের প্রলোভনে মহিলাদের দলীয় ভোটারে পরিণত করার জন্য নানা স্তরে নানা গবেষণা চলছে অহরহ, তখন ভাবতে অবাক লাগে, প্রায় শতবর্ষ পূর্বে মহিলাদের জন্য শিল্পভবন গড়ে তোলেন তিনি। খেলনা তৈরী, মাটির কাজ, তাঁত, রং ও ছাপার কাজ, চর্ম শিল্প, সূচি শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মাফিক নানা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। নানা স্থানে মহিলাদের হাতের কাজের প্রদর্শনী শুরু হয়। হাজার হাজার মানুষ সেখানে এসে চরকা কাটা, সুতা, সুতি ও রেশমের কাপড়, দরজির কাজ, কার্পেট বোনা,সুঁচের কাজ, পুঁতির কাজ, নারকেলের নানা মিষ্টি, চাটনী, আচার, খেলনা, ছবি, বাগানের ফসল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেন এবং উত্সাহিত করেন। জগদীশচন্দ্রের মৃত্যুর পর সঞ্চিত এক লক্ষ টাকা দিয়ে “সিস্টার নিবেদিতা উইমেন্স এডুকেশন ফান্ড” প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এছাড়াও চালু করেন “এডাল্টস প্রাইমারী এডুকেশন” নামে একটি প্রতিষ্ঠান।

বিশ শতকে শুধু বাংলা নয়, দেশ জুড়ে মহিলাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হয় অ্যানি বেসান্ত , সরোজিনী নাইডু, ডরোথি প্রমুখের নেতৃত্বে। গড়ে ওঠে সর্বভারতীয় মহিলা সংগঠন-WIA . এদের মূল লক্ষ্য ছিল নারী শিক্ষার বিস্তার,বাল্য বিবাহ রোধ, মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার ও ভোটাধিকার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। বাংলায় এ কাজে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন যাঁরা- তাঁদের অন্যতম লেডি অবলা বসু ।
আজ যখন দিকে দিকে নারী স্বাধীনতার নামে নানা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও পদক্ষেপে মানবতা লাঞ্ছিত হয় ,তখন লেডি অবলা বসুকে স্মরণ ও পুনর্পাঠ প্রয়োজনীয় সামাজিক নিদান মনে হয় ।

- Advertisement -
Latest news
Related news