স্বভাববিজ্ঞানী
গোপালচন্দ্র বিনোদ মন্ডল
বঙ্গবাসী পত্রিকা ১৯২০ সালের পৌষ সংখ্যায় ‘পচা গাছপালার আশ্চর্য আলো বিকিরণের ক্ষমতা’ শিরোনামে একটি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করে। অখ্যাত এক শিক্ষকের লেখা প্রবন্ধটি পড়ে চমকে যান আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসু। তাঁকে ডেকে পাঠান। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস সেই মানুষটিকে জগদীশ চন্দ্রের কাছে নিয়ে আসেন। আটপৌরে এই উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর নাম গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য (০২/০৮/১৮৯৫ — ০৮/০৪/১৯৮১)।
গোপালচন্দ্রের জন্ম ফরিদপুরের লোনসিং গ্রামে। জলা জঙ্গলে ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রামটির এক দরিদ্র কুলীন ব্রাহ্মণ অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর বাবা। যজমানি ছিল জীবিকা। রক্তে ছিল সংস্কৃত চর্চার নেশা। যদিও খুব বেশিদিন বাবার সান্নিধ্য লাভ ঘটেনি তাঁর। শৈশবেই বাবাকে হারান। মা শশিমুখী চরম দুঃখকষ্টের মধ্যে চারটি ছেলেমেয়েকে মানুষ করেন ।
বড় ছেলে গোপালচন্দ্রকে যজমানি , লেখাপড়া এবং মায়ের সাথে সংসারের পাঁচ মিশালি দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে। গ্রামের লোনসিং স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন। জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন। পরে এক শুভানুধ্যায়ীর আর্থিক আনুকূল্যে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশুনার সুযোগ ঘটে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। বিশ্বব্যাপী মন্দার ধাক্কায় পড়াশুনা বন্ধ করে ঘরে চলে আসতে হয়।
১৯১৫ সালে ১৯ বছর বয়সে গ্রামের স্কুলেই শিক্ষকতা শুরু করেন গোপালচন্দ্র। টানা পাঁচ বছর শিক্ষকতা করেন। এই সময়ে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। শিক্ষকতার সময়টুকু বাদ দিলে বাকি সময়ে বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে কীট পতংগের গতিবিধি , জীবনযাপন, ঝোপজঙ্গলের অজানা রহস্য, বনবাদাড়ের নিজস্ব চরিত্র উদ্ঘাটনে পাগলের মতো লেগে থাকতেন। এবিষয়ে ছাত্রাবস্থায় তাঁকে আগ্রহী করে তুলেছিলেন ঐ স্কুলেরই যোগেন মাস্টার, পরে তিনি যাঁর সহকর্মী হয়েছেন ।
‘মনে পড়ে’ স্মৃতি কথায় গোপালচন্দ্র লিখেছেন — “মাঝে মাঝে যোগেন মাস্টার ছেলেদের ডেকে এনে ম্যাজিকের খেলা দেখতেন। একটা মজার জিনিস দেখাবেন বলে একদিন তিনি সব্বাইকে ডেকে নিয়ে এলেন। পকেট থেকে গাঢ় খয়েরি রঙের কতগুলি বিচি বের করে টেবিলের ওপর রাখার কয়েক মিনিট পরেই একটি বিচি প্রায় চার ইঞ্চি উঁচুতে লাফিয়ে উঠল। তারপর এদিক ওদিক থেকে প্রায় সবগুলি থেকে থেকে লাফাতে শুরু করে দিল। … অবশেষে মাস্টারমশাই ছুরি দিয়ে একটা বিচি চিরে ফেলতেই দেখা গেল তার ভিতরে রয়েছে একটা পোকা (লার্ভা)’।
তীক্ষ্ণ মেধাবী গোপালচন্দ্রের সাহিত্য চর্চায়ও ঝোঁক ছিল। নানা সময়ে সুযোগ পেলেই দেওয়াল পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। হাতে লিখে ছোটদের লেখায় উৎসাহিত করেছেন। বাংলার কীটপতংগ তাঁর প্রতিনিধি স্থানীয় গ্রন্থ। ১৯৭৫ সালে এই গ্রন্থ তাঁকে এনে দেয় রবীন্দ্র পুরস্কার। ‘করে দেখ’ শীর্ষক গ্রন্থটির তিনটি খণ্ড বিজ্ঞানপিপাসু আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠে। অনেকগুলি গ্রন্থের অনুবাদও করেছেন। সম্পাদনা করেছেন ‘ভারতকোষ’ নামের বিশ্বকোষ। দেশি বিদেশি পত্রিকায় হাজারের বেশি প্রবন্ধ লিখেছেন ।আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকা ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে প্রকাশিত হয়েছে বাইশটি প্রবন্ধ।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে জগদীশ চন্দ্রের আহ্বানে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে যোগ দেন। তার আগে প্রবাসী পত্রিকায় জৈবদ্যুতি প্রবন্ধটি (১৯১৮) যথেষ্ট সাড়া ফেলে দেয়। বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি না থাকায় আজীবন নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৫১ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সামাজিক পতংগ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রে ভারতীয় শাখা পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হয়েও সেই কারণে সম্ভবত যাওয়া হয়ে ওঠেনি তাঁর ।
আলেয়ার আলো নিয়ে গ্রাম বাংলার নিশুতিরাতে নানা অবৈজ্ঞানিক বিভ্রম আজও সুপ্রচলিত। গোপালচন্দ্রই প্রথম ‘পাঁচীর মার ভিটাতে’ বর্ষণমুখরিত রাতে নৈশ অভিযান চালিয়ে সত্য উদ্ঘাটন করেন ও সর্বসমক্ষে তা প্রকাশও করেন। আত্মচরিতে আছে -“পতিত একটা গাছের গুঁড়ি থেকে আলো নির্গত হচ্ছিল।. .. .. .এই অপরূপ দৃশ্য আর কখনো নজরে পড়েনি। বিস্ময়ের পরিসীমা রইলো না ।. .. .. .. গুঁড়িটার পাশেই ,আমাদের দিকে, বেশ বড় একটা কচু গাছ জন্মেছিল। তার পাতা এমন ভাবে হেলে পড়েছে যে একটু বাতাসেই উপর- নিচে ওঠা -নামা করে অান্দোলিত হত ।দূর থেকে আলোটাকে একবার জ্বলতে আবার নিভে যেতে দেখেছিলাম – এখন তার প্রকৃত কারণ বোঝা গেল।”
আলেয়ার সম্বন্ধে এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সময়ও তাঁর জানা ছিলনা পচে যাওয়া লতা গুল্ম ও ঘাস পাতা ,খড় বিচালি জলে ভিজে যাওয়ার ফলে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে আর সেই গ্যাস যখন বায়ুর সংস্পর্শে আসে জ্বলে ওঠে আলো ।
একসময় আলোকচিত্রী হিসেবে কীট পতঙ্গের নানা স্থিরচিত্র তুলেছেন। লক্ষ করেছেন তাদের গতিবিধি। গোপালচন্দ্রের কাছ থেকে বাঙালি জেনেছে মাকড়সা, পিঁপড়ে , শুঁয়োপোকা, প্রজাপতি, ব্যাঙ, টিকটিকি , বোলতা, কানকোটারি পোকার জীবন চর্যা। তাদের যৌনক্রিয়া, খাদ্যাভ্যাস, শিকার , ডিমের প্রতি অপত্যাচার , পুরুষ ও স্ত্রীর আচরণভেদের খুঁটিনাটি। ব্যাঙাচির ওপর পেনিসিলিন প্রয়োগ করে তিনি প্রমাণ করেছেন ,পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে রূপান্তরিত হতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগছে যে !
বসু বিজ্ঞান মন্দিরের চার দেওয়াল থেকে বিজ্ঞান গবেষণা ক্ষেত্রকে তিনি প্রসারিত করেছেন পথ ঘাট, নদী নালা , ঝোপ ঝাড় , জলাভূমি কিংবা উষর প্রান্তরে। সেই সব পর্যবেক্ষণ প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করেছেন প্রবাসী, বঙ্গবাসী, দেশ এবং আনন্দবাজার পত্রিকায়। নিজের সম্পাদনায় প্রকাশিত জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায়। ইংরেজিতে লিখেছেন বোম্বাই থেকে প্রকাশিত ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির মুখপত্র মর্ডান রিভিউ , সায়েন্স এন্ড কালচার ইত্যাদি পত্রিকায়।
আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগের ফলে তাঁর গবেষণায় মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত জার্মান প্রকৃতিবিজ্ঞানী হ্যানস মলিস ভিজিটর প্রফেসর হয়ে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে যোগ দেন। প্রায় ছয় মাস তিনি কলকাতায় অবস্থানকালে জগদীশ চন্দ্রের নির্দেশে তাঁর যোগ্য সহকারী হিসেবে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন গোপালচন্দ্র। এই সময় কীট পতঙ্গের আকৃতি প্রকৃতি ,খাদ্য সংগ্রহের ধারা, আত্মরক্ষার কৌশল, বংশ বিস্তারের বৈচিত্র্য , আলো দেওয়া কীট পতঙ্গ এবং লতাপাতা নিয়ে গবেষণার ধারায় অনেক শাণিত হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৪৮ সালে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আহ্বানে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যুক্ত হন তিনি। পরিষদের মুখপত্র জ্ঞান ও বিজ্ঞান সম্পাদনার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন।
সাহিত্য চর্চা বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি লোকগীতি রচনায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। ফরিদপুরে থাকার সময় পালাগান ও জারিগানের আসরে তাঁর অনিবার্য উপস্থিতি পরিলক্ষিত হত।
আজকের জনবিজ্ঞান আন্দোলনের পথিকৃৎ বলা যায় তাঁকে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কাজে একদল গবেষক ও বিজ্ঞানীকে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না মিললেও বাংলায় তথা ভারতের বুকে প্রকৃতি বিজ্ঞান চর্চায় অনলস ভূমিকা পালন করেছেন আজীবন। তাঁরই স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে লাভ করেছেন আচার্য্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু ফলক। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর মাস তিনেক আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি. এসসি উপাধিতে ভূষিত করেছে । ২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিজ্ঞান জনপ্রিয় করণ কর্মসূচি ধারাবাহিক ও সুদূরপ্রসারি করবার লক্ষ্যে গোপালচন্দ্র ভাট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার চালু করেছে ।
তবু দেশজুড়ে যখন শিক্ষক দিবস উদযাপন করা হলো ধুমধাম সহযোগে, তখন এই বিজ্ঞানীশিক্ষকের অবদান নিয়ে বাঙালিকে বড় উদাসীন দেখে মর্মবিদারী কষ্ট হয়।