অকুতোভয়
বাঘা যতীন বিনোদ মন্ডল
১০ সেপ্টেম্বর,১৯১৫। পুলিশের গুলিতে আহত এক বাঙালী বিপ্লবী প্রয়াত হলেন বালেশ্বর হাসপাতালে। পুলিশ কমিশনার টেগার্ট বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে বুড়িবালামের তীরে তাঁর সাথে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হন। হাসপাতালে তাঁর প্রয়াণের পর টেগার্ট তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন -I have met the bravest Indian. I have the greatest regard for him but I had to do my duty.
এই অকুতোভয় বীর যোদ্ধার নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। আমাদের প্রিয় বাঘা যতীন।
০৮.১২.১৮৮০ তে জন্ম। জন্ম গ্রহণ করেছিলেন কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। বাবা উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মা- শরৎশশী দেবী। তারুণ্যে ছোরা দিয়ে একটি বাঘ শিকার করে বাঘা যতীন নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন । শৈশবে পিতৃ বিয়োগের ফলে মায়ের রুচি ও মূল্যবোধে চরিত্র গঠন হয় যতীনের। মা ছিলেন স্বভাবকবি। সংস্কৃতিপ্রাণ যতীন অভিনয় ভালবাসতেন। বিশেষ করে পৌরাণিক নাটকে। হনুমান, হরিশচন্দ্র, ধ্রুব বা প্রহ্লাদ ছিল তাঁর প্রিয় চরিত্র। পাশাপাশি শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় চোস্ত ছিলেন। যখন যেখানে থেকেছেন, সেখানের ক্লাব কালচারের আড়ালে গড়ে তুলেছেন স্বাধীনতাকামী পিছুটানহীন যুবকদের গুপ্ত সংগঠন।
কৃষ্ণনগরের আর এক বিপ্লবী হরিপদ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর আপন মামাতো ভাই। বড় মামা বরেণ্য আইনজীবী ও আইনের অধ্যাপক বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম আইনি উপদেষ্টা। তিনিই যতীনকে কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজে পড়তে পাঠান। এখানে এসে সাক্ষাত ঘটে বিবেকানন্দের সাথে। পাশেই তাঁর বাড়ি। বিবেকানন্দের সান্নিধ্যে তাঁর অধ্যাত্মচেতনা, স্বদেশচেতনা জাতি গঠনের ভাবনা দৃঢ় হয়। বিবেকানন্দের পরামর্শে তিনি প্রখ্যাত কুস্তিবিদ অম্বুজ গুহের আখড়ায় যোগ দেন। কলকাতায় প্লেগ মহামারি মোকাবিলায় বন্ধুদের নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ছুটে বেড়ান ।
যতীন্দ্রনাথের বর্ণময় জীবন যেকোনো দুঃসাহসিক সিনেমার মতো রোমাঞ্চকর। মায়ের মৃত্যু শয্যায় দেখা করতে গিয়ে দিদি বিনোদবালার কাছে শোনেন ইন্দুবালার কথা। ১৯০০তে বাগদত্তার পাণি গ্রহণ করেন। পরে কর্মসূত্রে মজফ্ফরপুর, দেওঘর থেকে দার্জিলিং সর্বত্র সপরিবারে কাটিয়েছেন। সংসারধর্ম পালন করেছেন। তাঁর চরিত্রের আর একটি অভিনব দিক হলো, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এতটা দূরদর্শী ছিলেন যে, সাধারণের পক্ষে তাঁর কর্মকাণ্ড আন্দাজ করা কঠিন ছিল। জার্মান যুবরাজ থেকে ব্রিটিশের উচ্চপদস্থ অফিসার, সবার সাহচার্য্য কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছেন তিনি।
ধরা যাক কেনেডি সাহেবের কথা। তিনি ছিলেন ভারত দরদী আইন ব্যবসায়ী। ১৮৯৯ নাগাদ তাঁর সেক্রেটারি হয়ে মজফ্ফরপুরের বাসিন্দা হন যতীন। তখনও বিয়ে হয়নি। সেখানে ফুটবল ক্লাব, আথেলেটিক্স চর্চা কেন্দ্র গড়ে তুললেন। তার আড়ালে গুপ্ত সমিতি গড়ার প্রয়াস অব্যাহত ছিল। এই কেনেডি সাহেবের স্ত্রী ও কন্যা ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকির ছোঁড়া বোমার আঘাতে নিহত হন । ক্ষুরধার সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে তিনি ভবিষ্যতের জন্য ত্রিস্তর কর্মসূচী রূপায়নের পরিকল্পনা করেন। প্রথম পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে এক একটি শহরে বা মফস্সলেএক একজন বিপ্লবী নাশকতা ঘটিয়ে শহিদ হবেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে এক একটি ছোট ছোট দলে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে উপর্যুপরি খণ্ড যুদ্ধে সামিল হবেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। ব্যতিব্যস্ত করে তুলবেন পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনকে। রাতের ঘুম চলে যাবে শাসকের। যেভাবে ১৮৫৭তে চেষ্টা করা হয়েছিল । শেষ ধাপে দেশব্যাপী সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংঘটিত হবে। যার মাধ্যমে গণ আন্দোলন সার্বিক বিকাশের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনবে বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে ১৯০৬ নাগাদ তিনি সপরিবারে দেওঘরের বাসিন্দা। বারীনের সাথে যৌথ কর্মসূচি গৃহীত হচ্ছে। বাংলা নয় বিহার মুলুকে দুজনে মিলে গড়ে তুলেছেন বোমা কারখানা।সেই শিক্ষায় প্রশিক্ষিত বারীন ঘোষ মানিক তলায় এসে নতুন করে কাজ শুরু করেছেন। জেলায় জেলায় গুপ্ত সমিতি গড়া হচ্ছে। প্রসারিত হচ্ছে নানা দিগন্ত।
১৯০৬ সালে স্যার ডানিয়েল হ্যামিলটনের সহযোগিতায় বৃত্তি সহ মেধাবী ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাচ্ছেন তিনি। তারকনাথ দাস,গুরুনাদিত কুমার, শ্রীশ সেন, অধর লস্কর, সত্যেন সেন, জিতেন লাহিড়ী, শৈলেন ঘোষ। যতীনের নির্দেশ শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক লড়াইয়ের কায়দা ও বিস্ফোরক প্রস্তুতির প্রযুক্তি রপ্ত করতে হবে। বিদেশে ব্রিটিশ বিরোধী জনমত তৈরী করতে হবে ।
দার্জিলিংএ থাকার সময় শিলিগুড়ি স্টেশনে ক্যাপ্টেন মার্ভি সহ চারজন সামরিক অফিসারের সাথে যতীনের মারামারি হয়। কথিত আছে ব্রিটিশের চার পরীক্ষিত অফিসারের চোয়ালে ফ্র্যাকচার ধরা পড়ে। মামলা রুজু হয়। হাসাহাসি পড়ে যায় দেশে। কাগজে কাগজে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ বেড়ে যেতে সরকার চাপ দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করায়। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বিলিতি ঠাট বজায় রাখতে যতীনকে শাসানি দেয় -‘ এমনটি যেন আর না ঘটে।’ উত্তরে দর্পিত যতীন বলেন- ‘নিজের সম্মান বা দেশবাসীর সম্মান বাঁচাতে যদি প্রয়োজন হয়, এমনটি যে আবার করবো না- এ শপথ আমি করতে অপারগ’ ।
হুইলার সাহেব এই কান্ডের পর একদিন পরিহাস ছলে যতীনকে জিগ্যেস করেন ‘একা হাতে ক’টা লোককে আপনি শায়েস্তা করতে পারেন?’ যতীন সহাস্যে বলেন -‘ভালো মানুষ যদি হয়, একটাও না, দুর্বৃত্ত হলে যতগুলো খুশি সামলাতে পারবো।’
এই মহাজীবনের চর্চা আজকের ছন্দ ছুট ভারতবর্ষে শতগুণে বিকশিত হওয়া দরকার। আলিপুর বোমা মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দা অফিসার মৌলবী শামসুল হককে গুলি করে হত্যা করেন বিপ্লবী বীরেন্দ্র দত্তগুপ্ত। সেতো তাঁরই নির্দেশে। যার ফলশ্রুতিতে পুলিশ যতীনকে গ্রেপ্তার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কয়েদ করে ।
গুপ্ত সমিতি গড়তে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন এদেশে গণ অভ্যুত্থান ঘটাতে হলে ইংরেজ বিরোধী রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা দরকার। তখন বাণিজ্যক্ষেত্রে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী – জাপান। তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। জাপানের কাছ থেকে সাহায্যের আশায় রাসবিহারী বসুর কাছে গোপনে অবনী মুখার্জীকে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। জার্মানীর যুবরাজ কলকাতায় এলে দেখা করে অস্ত্র ও রসদের জন্য প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই ‘জার্মান প্লট’ ভবিষ্যতে সুভাষচন্দ্রকে প্রাণিত করেছিল বলে মনে হয় ।
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (এম এন রায়) এবং জিতেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর যোগাযোগে জার্মান সরকার এক জাহাজ অস্ত্র শস্ত্র পাঠায়। যতীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সহযোদ্ধারা ডাকাতি করে যার খরচ তুলেছিলেন। কিন্তু ১৯১৫ সালে ওয়াশিংটনের কাছে আমেরিকা সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে। দ্বিতীয়বার আন্দামানের কাছে বৃটিশ রণতরী অন্য একটি অস্ত্র বোঝাই জাহাজ ডুবিয়ে দেয় জলে। হতাশায় ভেঙে পড়েননি যতীন্দ্রনাথ। বরং পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে নীরেন্দ্রনাথ, চিত্তপ্রিয়, জ্যোতীষচন্দ্র এবং মনোরঞ্জনকে সাথে নিয়ে বালেশ্বরে জীবনের শেষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। দৃঢ়স্বরে বলেন -‘আর পালানো নয়। যুদ্ধ করে আমরা মরবো। তাতেই দেশ জাগবে ।
হাতে মাউজার পিস্তল। পরিখার আড়ালে যতীনের নেতৃত্বে মোট পাঁচজন সংশপ্তক বিপ্লবী। যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমেই শহিদ হন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী। গুলিতে আহত যতীন বালেশ্বর হাসপাতালে রক্ত বমি করতে করতে ক্লান্ত,অবসন্ন। হাসি হেসে তবু বলছেন -‘এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশ মাতার চরণে ।’★