Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৭২।। নবীনচন্দ্র সেন।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

বাংলার বায়রন
নবীনচন্দ্র সেন বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

ঊনবিংশ শতকের বাংলা কেঁপে উঠেছিল একটি কবিতার শিরোনামে। সমসময়ে অভাবিত এই কাব্য পরিকল্পনা নিয়ে কোনো বিরূপ সমালোচনা যে একেবারে হয়নি তা নয়। তবে এ নিয়ে বিশেষ কোনো ঝড় ওঠেনি। কবিতার নাম – কোন এক বিধবা কামিনীর প্রতি। এডুকেশন গেজেট পত্রিকায় মুদ্রিত হলো এই সাহসী সৃষ্টি। স্রষ্টা- নবীনচন্দ্র সেন ( ১০ ফেব্রু: ১৮৪৭ — ২৩ জানু:১৯০৯)।

বাবা বিখ্যাত জমিদার-গোপীমোহন রায়। মা – রাজ রাজেশ্বরী দেবী। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত নোয়াপাড়ার প্রবীণ জমিদার বংশে জন্ম নবীনচন্দ্রের। পৈত্রিক নিবাসস্থল – পশ্চিম গুজরা। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের মেধাবী ছাত্র নবীন জেনারেল অ্যাসেম্ব্লিজ ইনস্টিটিউশন থেকে বি. এ.পাশ করেন। প্রথম চাকরি হেয়ার স্কুলে। তৃতীয় শিক্ষকের। তবে ইতিহাস বলছে এই চাকরি প্রাপ্তির নেপথ্যে শাসকের সুপারিশ ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ তখন সাটিক্লফ সাহেব। তিনিই নবীনচন্দ্রের জন্য চিঠি লেখেন।

কিছুদিন পরে (১৮৬৮) ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন নবীনচন্দ্র সেন। নানা প্রশাসনিক পদে দীর্ঘ ৩৬ বছর কাজ করেছেন তিনি। বাংলা বিহার ও ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ এলাকায় কাজ করতে গিয়ে দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। তবে স্পষ্টবাদী ছিলেন বলে বারবার বদলির শিকার হতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিদিন কাটিয়েছেন ফেণীতে। আট বছর। আজকের মনোরম শহর ফেণীর রূপকার বলা হয় তাঁকে। প্রতিষ্ঠা করেন ফেণী সরকারী পাইলট স্কুল। ১৯০৪ এর পয়লা জুলাই অবসর নেন নবীনচন্দ্র সেন ।
১৮৯৩ সালে রানাঘাটের মহকুমা শাসক হন তিনি। এখানে দু বছরেরও কম সময়ে মহকুমা শাসক হিসেবে ছাপ ফেলেছেন জনমানসে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি কীর্তি স্থাপন করেন এই সময়ে। ফুলিয়ার মহাকবি কৃত্তিবাস ওঝার জন্মভিটের সন্ধান পান। নিজে মহকুমা শাসক থাকায় সরকারি স্বীকৃতি প্রদানেও অসুবিধে হয়নি। এই রানাঘাটে থাকার সময় তাঁর বিখ্যাত ট্রিলজি কুরুক্ষেত্র রৈবতক ও প্রভাস প্রকাশিত হয়। দিকে দিকে দেশপ্রেমিক কবি হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি।

নবীনচন্দ্র ছাত্রাবস্থাতেই পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। ফলে তাঁর চরিত্র গঠন ও জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে বিদ্যাসাগরের প্রভাব ফলবতী ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর থেকে বছর দশেকের বড় (১৮৩৮)। তিনিও তাঁর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন এবং অনুপ্রাণিত করেন। যদিও স্বয়ং নবীনচন্দ্র তাঁর স্বদেশীয়ানার গুরু হিসেবে মতিলাল ঘোষ এবং কাব্যচর্চার উপদেষ্টা হিসেবে সর্বাগ্রে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঋণ স্বীকার করেছেন।
একমাত্র জীবনচরিত – ‘আমার জীবন’ এ অভিমানাহত কবি আত্ম সমীক্ষা করেছেন। ” আমি এডুকেশন গেজেট লিখিতে আরম্ভ করিবার পূর্বে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র বিষয়ে খণ্ড কবিতা বঙ্গভাষায় ছিলনা …… অবকাশরঞ্জিনী বোধহয় বঙ্গভাষায় এরূপ ভাবের প্রথম খণ্ড কাব্য । ” এতো গেল তাঁর নিজের কথা। সমালোচকগণ তাঁকে নানা অভিধায় অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ তাঁর পূর্বে উল্লিখিত ট্রিলজিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাভারত ( Mahavarata of the nineteenth cenchury) বলেছেন ।

আখ্যানকাব্য, খণ্ডকাব্য, রোমান্স, স্বাদেশিকতা, ভক্তি বা ধর্মতত্ত্ব, পুরাণ, ইতিহাস মধ্যযুগীয় কুসংস্কার বনাম যুক্তিবাদ প্রভৃতি নানা বিষয়ে তাঁর কবিতা আন্দোলিত। উনিশ শতকের নবজাগরণের যুগধর্ম তাঁকে আলোড়িত করেছে আবার পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে পাওয়া ধর্মীয় গোঁড়ামিও বর্জন করতে পারেননি। ফলে দ্বিধাদীর্ণ মানসবৃত্তের ছায়া পড়েছে কাব্যমুকুরে। পলাশীর যুদ্ধ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি সন্দেহ নেই। মোট চোদ্দ খানি কাব্যের স্রষ্টা তিনি। রঙ্গমতি ক্লিওপেট্রা ও অমিতাভ সমসময়ের সামনে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। এছাড়া তাঁর লেখা একমাত্র উপন্যাস হল -ভানুমতী (১৯০০)।
‘ নিবুক নিবুক প্রিয়ে দাও তারে নিবিবারে / আশার প্রদীপ ।/ এই তো নিবিতেছিল কেন তারে উজলিলে / নিবুক সে আলো, আমি ডুবি এই পারাবারে।’ এই গীতি মূর্ছনা তাঁর কবিতার প্রাণ। যদিও প্রেম-প্রকৃতি-গার্হস্থ্য জীবনের চালচিত্র সমানভাবে তাঁর কাব্যে উপস্থিত হয়েছে। ক্লিওপেট্রা কবির নিজের পছন্দের হলেও একটি অখণ্ড দীর্ঘ বিবৃতিমূলক কবিতার ফর্মে রচিত এই কাব্য, রচনা শৈথিল্যে এ কবির দুর্বল সৃষ্টি।

‘পলাশীর যুদ্ধ কাব্য’ গ্রন্থে তিনি যে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা তুলে ধরেছেন ,তাঁর জন্য রাজরোষে পড়তে হয়। এদিকে ট্রিলজিতে মহাভারতের রাজনীতির নির্ণায়ক চরিত্র কৃষ্ণকে নতুন দৃষ্টিতে অঙ্কিত করেছেন কবি। এই তিনটিকে মহা কাব্যোপম সৃষ্টি বলা হয়। বাংলা কবিতার জগতে অখণ্ড স্বাদেশিকতা ও দেশপ্রেমের প্রমিত সুর প্রবাহিত করেছেন তিনি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে “বাঙ্গালার বায়রন ” আখ্যা দিয়ে প্রাণিত করেছেন। এদিকে নবীনচন্দ্র স্বয়ং পলাশীর যুদ্ধ এবং ভারতে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠাকে ‘এ নাইট অফ ইটারন্যাল গ্লুম ‘ বলে অভিহিত করেছেন।

- Advertisement -
Latest news
Related news