Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৬৯, মাস্টারদা সূর্য সেন।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

যুগান্তরের পথিক
মাস্টারদা সূর্য সেন বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

বিশশতকের বাংলা। বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। এমনই এক ঝোড়োদিনে এক মেধাবী ও মনোযোগী ছাত্রকে পরীক্ষার সময় টেবিলে পাঠ্য বই রাখবার অভিযোগে বিতাড়িত করল চট্টগ্রাম কলেজ। ধর্মভাবাপন্ন গম্ভীর প্রকৃতির ছাত্রটি নিজের অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য মার্জনা চাওয়ার সুযোগ পাননি। প্রিয় প্রতিষ্ঠানের অপ্রিয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যান। পরে ভর্তি হন বহরমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজে। তিনিই অনাগত আগামীতে মাস্টারদা অভিধায় ভূষিত হবেন। যার পিতৃদত্ত নাম সূর্য কুমার সেন (২২ মার্চ ১৮৯৪ –১২ জানুয়ারী ১৯৩৪)। ডাক নাম ছিল – কালু ।

মাস্টারদা জন্মেছিলেন চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়া পাড়ায়। বাবা- রাজমণি সেন। মা- শশীবালা দেবী। শৈশবে বাবা মাকে হারিয়ে কাকা গৌরমণির কাছে লালিত হন সূর্য ।
ভর্তি হন দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে চলে আসেন নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে। এখানে পড়েন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। পরের ঠিকানা – ন্যাশনাল হাই স্কুল। চট্টগ্রামের নন্দন কাননে হরিশ দত্তের এই স্কুল থেকেই তিনি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এর পরেই ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। এখান থেকে পাশ করেন এফ এ(ফার্স্ট আর্টস) এবং বি এ পরীক্ষায় পূর্বোক্ত বিড়ম্বনা!
এই বহরমপুর কলেজে পড়ার সময় কলেজের জনপ্রিয় অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর নিবিড় সান্নিধ্য তাঁর জীবনের গতিপথ ঠিক করে দেয়। বিপ্লবী দলের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে যান মাস্টারদা। বি এ পাশ করার পর চট্টগ্রামে ফিরে এসে হরিশ দত্তের পরামর্শে ন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। হরিশ দত্ত তখন চট্টগ্রাম ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য। তবে অসহযোগ আন্দোলনের সময় ঐ স্কুল বন্ধ করে দিতে হয়। দেওয়ান বাজারের বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন মাস্টারদা।

অঙ্কের ক্লাস নিতেন স্কুলে।কিন্তু ছুটির পর অবসর সময় ছাত্রদের সংগে কাটাতেন। তাদের শোনাতেন দেশ বিদেশের মুক্তিকামী মানুষের লড়াই সংগ্রামের কাহিনী। স্বাধীনতা সংগ্রামের মরণপণ গৌরবময় ইতিহাস। যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতির নানা টানাপোড়েন চলছে তখন। এই সময় কিছুদিন চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত দেওয়ানবাজারের দেওয়ানজি পুকুরপাড়ে প্রতিষ্ঠা করেন গুপ্তসমিতি “সাম্য আশ্রম”। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ তাঁকে ভীষণ নাড়া দেয়। দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করে । এ তারই প্রতিফলন ।
জীবনে দ্বিতীয়বার পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিড়ম্বনার মুখোমুখি হন সূর্য। ১৯১৯ সাল। তাঁর চোখ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্ন মুছে দিতে তাঁকে ঘরমুখো করতে চান কাকু কাকিমা। জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয় তাঁকে। পাত্রী পঞ্চদশী পুষ্পকুন্তলা দত্ত। ফুলসজ্জার রাতে, বিয়ের তিনদিনের মাথায় দেওয়ান বাজারের বাসা ছেড়ে চলে যান। কোনো কোনো গবেষক বলেছেন, তিনি বিয়ের রাতেই গৃহত্যাগ করেন। পরে একবারই দেখা হয় মুমূর্ষু স্ত্রীর সাথে। তিনি তখন মুম্বাই এ রত্নগিরি জেলে বন্দী ছিলেন। বহু দরখাস্ত লেখালেখির পর সরকার বাহাদুর তাঁর ছুটি মঞ্জুর করে। পুলিশ পাহারায় চট্টগ্রামে এসে স্ত্রীর মৃত্যুশয্যায় হাজির হন মাস্টারদা।

বাংলার জেলায় জেলায় বিপ্লবীরা তখন অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তরের শাখা গড়ে চলেছেন। সূর্য সেন নিজস্ব স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে সংগঠন বিকশিত করার কাজে ব্যস্ত। তবে কংগ্রেসের প্রকাশ্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোলকাতার যুগান্তর দলের সংগেই যোগাযোগ রাখতেন। সেই সুবাদে চট্টগ্রাম যুগান্তরের সাংগঠনিক নির্বাচনে সর্বসম্মতভাবে সভাপতি নির্বাচিত হন। সহসভাপতি হন অম্বিকা চক্রবর্তী। শহরে সংগঠন বিস্তারের দায়িত্ব পান গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিংহ। গ্রামীণ এলাকায় দায়িত্ব নেন নির্মল সেন। ছাত্র আন্দোলন ও ব্যায়ামাগার গঠনের দায়িত্বে আসেন লোকনাথ বল। বিপ্লবী দলের সংবিধান রচনার মতো তাত্ত্বিক দিকের ভার পড়ে অনুরূপ সেনের উপর। কলকাতার বিভিন্ন শাখার সাথে যোগাযোগ ও অস্ত্র সংগ্রহের মতো বিপজ্জনক কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নগেন্দ্রনাথ সেন।

১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর অনুরোধে এক বছর বিপ্লবীরা তাঁদের কর্মসূচি বন্ধ রাখেন। অন্য অনেকের সাথে সূর্য সেনও অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন গান্ধীজী। আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন বিপ্লবীরা। অবতীর্ণ হন স্বমহিমায়। তখন চট্টগ্রাম কোর্টের ট্রেজারি থেকে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন নিয়ে যাওয়া হতো। ১৯২৩ এর ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস মোড়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ১৭০০০ টাকা ভরা একটি বস্তা ছিনতাই করেন তাঁরা। এক পক্ষকাল পুলিশ কোনো হদিশ করতে পারেনি। তারপর গোপন আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে বিপ্লবীদের খণ্ডযুদ্ধ হয়।যা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ‘নাগরখানা পাহাড় খণ্ড যুদ্ধ’ নামে সুপরিচিত। দিনটা ছিল ১৯২৩ এর ২৪ ডিসেম্বর।

যুদ্ধের পর অন্যরা ফেরার হলেও গ্রেপ্তার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। শুরু হয় রেলওয়ে ডাকাতি মামলা। কোলকাতা হাইকোর্টে তাঁদের হয়ে সওয়াল করেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। সে যাত্রায় ছাড়া পেয়ে যান তাঁরা। তবে ইংরেজ সরকার সশস্ত্র আন্দোলন রুখতে ১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স অ্যাক্ট প্রবর্তন করে। জেলে থাকবার সময় কোলকাতা পুলিশ কমিশনার টেগাটের নির্দেশে বিপ্লবীদের অকথ্য শারীরিক নির্যাতন করা হয়। তার প্রতিশোধ নিতে টেগার্টকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তা পুলিশ আগাম জানতে পারে। একে একে সবাই ধরা পড়েন। এ যাত্রায় ১৯২৬ এর ৮ অক্টোবর সূর্য সেন গ্রেপ্তার হন। প্রথমে মেদিনীপুর জেল পরে রত্নগিরি জেল হয়ে বেলগাঁও জেলে স্থানান্তরিত হন তিনি। ১৯২৮ এর শেষে ছাড়া পান।

১৯২৮এ জেল থেকে ছাড়া পাবার পর কলকাতার পার্ক সার্কাসে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে চট্টগ্রাম থেকে তাঁর নেতৃত্বে কয়েকজন বিপ্লবী প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানে বৈঠক হয় সুভাষচন্দ্রের সংগে।
পরের জ্বালাময়ী অধ্যায় বহু আলোচিত। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মাস্টারদা গড়ে তোলেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি চিটাগাং ব্রাঞ্চ। ১৯৩০ এর ১৮ এপ্রিল চারটে দলে বিভক্ত হয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ করেন তাঁরা। রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে নিয়ে ধুম স্টেশনে একটি মালগাড়িকে লাইনচ্যুত করার ফলে বাংলাদেশ থেকে চট্টগ্রাম রেলপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অন্য একটি দল নন্দন কাননে টেলিফোন টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দেয়। একটি দল রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করেন। দামী রিভলবার ও রাইফেল সরিয়ে নিয়ে সেখানে ও আগুন ধরানো হয়।
সর্বশেষ দলটি দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। তারপর সবাই সমবেত হয়ে পুলিশ লাইনে সামরিক কায়দায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও কুচকাওয়াজ করেন। সেখানে সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন সূর্য সেন।

চার চারটে দিন বয়স ছিল এই সরকারের। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থানরত বিপ্লবীদের আক্রমণ করে সশস্ত্র ইংরেজ বাহিনী। দু ঘন্টার মরণপণ লড়াইতে ৭০ থেকে ১০০ জন ব্রিটিশ সৈন্য প্রাণ হারায়। শহিদ হন মাস্টারদার ১২ জন সৈনিক।
বহুবার ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৩২ এর ১৩ জুন রাতে পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাকে নাগালে পায় ইংরেজ। কিন্তু ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে মাস্টারদা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত পালাতে সক্ষম হন। গুলিতে প্রাণ হারান নির্মল সেন। মাস্টারদার পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ। যার নেতৃত্ব ভার তিনি অর্পণ করেন প্রীতিলতার উপর। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়। গুলিবিদ্ধ প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী নেত্র সেনের বিশ্বাস ঘাতকতায় ধরা পড়েন তিনি। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারী চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তাঁকে। মৃতদেহ আত্মীয়দের দেওয়া হয়নি। হিন্দু মতে পোড়ানোও হয়নি। বুকে লোহার টুকরো বেঁধে সাগরের জলে নিক্ষেপ করা হয়।

- Advertisement -
Latest news
Related news