Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৬৩, ইন্দিরা চৌধুরানী ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

বিদুষী
ইন্দিরাদেবী

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে
কবির সঙ্গে ইন্দিরা দেবী

বিনোদ মন্ডল

জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির প্রথম মহিলা – যিনি বি.এ. পাশ করেন। বাবা সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন এদেশের প্রথম বাঙালী আই. সি. এস। মা জ্ঞানদানন্দিনী ছিলেন মুক্তচিন্তার প্রতিভাময়ী ব্যক্তিত্ব। লেখিকা। পত্রিকা সম্পাদিকা। বঙ্গসংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে বিচরণশীলা। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী এবং ভাবশিষ্যা। তিনি ইন্দিরাদেবী (২৯.১২. ১৮৭৩ — ১২.০৮. ১৯৬০)।
১৮৫৭ সালে অভিজাত প্রতিষ্ঠান লরেটো হাউস থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন ইন্দিরাদেবী। ফরাসী ভাষা নিয়ে প্রথম বাঙালী নারী যিনি নিবিড় পড়াশুনা করেন। বি. এ. পরীক্ষায় ইংরেজিতে প্রথম হয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদ্মাবতী স্বর্ণ পদক লাভ করেন।

‘ সবুজপত্র’ সম্পাদক এবং বাংলা গদ্যের অন্যতম নবরূপকার প্রমথ চৌধুরীর সংগে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন ফরাসী ভাষায় সুপণ্ডিত। প্রাক্ বিবাহ পর্বে ইন্দিরাকে নিয়ে চৌধুরী পরিবারের আকর্ষণের অন্ত ছিল না । সে সব ঘটনা নিয়ে নানা মিথ আজ বহু বিদিত। বরং সুন্দরী ইন্দিরার প্রতি প্রমথ’র বিকর্ষণ ছিল বেশি। একটি ঘটনার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে আলবার্ট হলের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন রবীন্দ্রনাথ। সংগে যান ইন্দিরাও । প্রেসিডেন্সির ছাত্র প্রমথকে তাঁর বন্ধু নারায়ণ শীল সেই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শোনাতে নিয়ে যেতে চান। প্রমথ নারাজ। নারায়ণ নাছোড়। বন্ধুর সম্মতি আদায়ের জন্য শ্রী শীল বলেন – ‘বক্তৃতা না শুনতে যাও, শোন না, অন্তত তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রীটিকে দেখে আসি চল। শুনেছি মেয়েটি অতি সুন্দরী।` ক্ষুব্ধ প্রমথ চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া – ‘পরের বাড়ির খুকি দেখবার লোভ আমার নেই।’ পরে প্রণয়াসক্ত প্রমথকে ইন্দিরা দেবী ফরাসী ভাষায় ‘mon ami’ সম্বোধন করতেন, স্মৃতি কথায় ধরা আছে।

ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় যে নাট্যচর্চা ধারাবাহিক চালু ছিল একটা সময় – অভিনয় করেছেন ইন্দিরাদেবী। অসাধারণ গুণী এই নারী দেশী বিদেশী সুরে পিয়ানো বেহালা সেতার বাদনে সিদ্ধহস্তা ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের হারিয়ে যাওয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু গানকে উদ্ধার করেছেন। সযত্নে রক্ষা করেছেন। ১৯২৬ সালে গীতিকার রবীন্দ্রনাথ ও প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ রেকর্ড কোম্পানীগুলির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন -রবীন্দ্রসংগীতকে সুসংহত ও সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে সংরক্ষণের জন্য রেকর্ড করার লক্ষ্যে। এই প্রক্রিয়াকে ইন্দিরাদেবী প্রসারিত ও বিকশিত করেন। ১৯৪৮ সালে অনাদি কুমার ঘোষ দস্তিদারের অধীনে স্বরলিপি সমিতি গঠিত হয়। সেখানেও সক্রিয় উদ্যোগ ছিল ইন্দিরা দেবীর। শুধু কি তাই, মিউজিক বোর্ড প্রতিষ্ঠা, নির্ভুল সুরে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনে নিষ্ঠতা , গ্রামোফোন কম্পানী গুলোর দ্বারা মিউজিক বোর্ডের অনুমোদন নেওয়া, সব কাজেই নেপথ্যচারিণী ইন্দিরাদেবী । রবীন্দ্র সংগীতের যে বিপুল প্রভাব বাংলাগানের দুনিয়ায় পরিলক্ষিত হয় – সেখানে তাঁর মেধাবী পরিশ্রমের নানা স্বাক্ষর বিরাজমান। মায়ার খেলা, ভানুসিংহের পদাবলী, কালমৃগয়া প্রভৃতি গীতিনাট্যসহ প্রিয় রবিকাকার দুইশতাধিক গানের স্বরলিপি নির্মাণ করেছেন ইন্দিরাদেবী। রবীন্দ্রসংগীতে স্বকীয়তা ও বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রশ্নে অপ্রতিম অবদান রয়েছে তাঁর ।
রবীন্দ্র প্রয়াণের (১৯৪১) পর শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র কাব্যাদর্শকে অটুট রাখতে দুই দশক ধরে নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন ইন্দিরা। সেই সূত্রে ১৯৫৬ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য্য হন তিনি । অর্জন করেন ‘দেশিকোত্তম’ সম্মান। রবীন্দ্র ভারতী সমিতি তাঁকে বিরল সম্মানে ভূষিত করেছে। তিনিই ‘রবীন্দ্র পুরস্কার ‘- এর প্রথম প্রাপক হয়েছেন। শুধু শান্তিনিকেতন নয়, ব্যাপ্ত পরিসরে -‘ উইমেন্স এডুকেশন লীগ’, এবং ‘অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স’ সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অন্যতম থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ছিলেন ইন্দিরা দেবী ।

বিশ শতকের সূচনায় তিনিই প্রথম নারী যিনি গল্প উপন্যাস বা কবিতার ছকে বাঁধা পথে না হেঁটে প্রবন্ধ, স্মৃতি চারণা, অনুবাদ সাহিত্য রচনায় আজীবন রত থেকেছেন। গঠন করেছেন ‘সংগীত সংঘ। রবীন্দ্রসংগীতের “ত্রিবেণী সঙ্গম” এ আপামর সংগীতপ্রেমী বিশ্ববাসীকে স্নাত করেছেন তিনি। সুর-স্বর, লিপি এবং তথ্য ও তত্ত্বের দর্পণে রবীন্দ্রসংগীতের দার্শনিক ও তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় অনবদ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। কলিকাতা ‘সংগীত সম্মিলনী’ গঠনের পেছনে মনস্বী উদ্যোগে অন্যদের সাথে তিনিও ছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি সুবীর ঠাকুরের বড় মেয়ে সুপূর্ণা তাঁর সাংগীতিক মহিমাকে অমরত্ব প্রদানের উদ্দেশ্যে স্থাপন করেন ‘ইন্দিরা সংগীত শিক্ষায়তন।’
কাকা রবীন্দ্রনাথের ‘জাপান যাত্রীর ডায়েরী’ গ্রন্থসহ বহু গল্প ,প্রবন্ধ, কবিতার অনুবাদ করেন। এছাড়াও ‘টেল্স অব ফোর ফ্রেন্ডস’ শিরোনামে চার ইয়ারী কথা’ র ইংরেজী অনুবাদ করেছেন। ইংরেজীতে লিখেছেন দি অটোবায়োগ্রাফী অব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ টেগোর। ফরাসী থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন – রেনে গ্রুসের ভারতবর্ষ। পিয়ের লেডির কমল কুমারিকাশ্রম। মাদাম লেডির — ভারত ভ্রমণ কাহিনী। রবীন্দ্র পৃষ্ঠপোষকতায় ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকায় রাসকিন বন্ডের অনুবাদ করেছেন।

নারী স্বাধীনতা ও নারীমুক্তির আন্দোলনে অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। যার প্রমাণ ‘নারীর উক্তি’ প্রবন্ধ। এখানে তিনি বঙ্গ নারীর শুভাশুভ নিয়ে মৌলিক ভাবনার স্ফুরণ ঘটিয়েছেন। এছাড়া বাংলার ‘স্ত্রী আচার’ বেশ কয়েকটি ‘স্মৃতিকথা’ এবং ‘পুরাতনী’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। প্রবাসী পত্রিকার বিখ্যাত সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে ‘পুরাতনী’ গ্রন্থ রচনায় হাত দেন তিনি। যেখানে তাঁর মা জ্ঞানদানন্দিনীর বয়সকালের স্মৃতিকথা অনুলিখনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে ঠাকুরবাড়ির পুঙ্খানুপুঙ্খ স্মৃতিকথা রচনার কৃতিত্ব তাঁরই। তাই সাহিত্য কৃতির জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ভুবনমোহিনী’ পদকে অলঙ্কৃত করেন।

ঘরজামাই থাকবার শর্তে উকিল ও সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তবে পাকে চক্রে বেশিদিন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে থাকা হয়ে ওঠেনা এই নিঃসন্তান দম্পতির। ১নং ব্রাইট স্ট্রিটে থিতু হন তাঁরা। বিশাল বড় বাড়ির নাম রাখা হয় তাৎপর্যময় -‘ কমলালয়’। এখান থেকেই ‘সবুজ পত্র’ প্রকাশিত হয়। সাধ ও স্বপ্নের সেই কমলালয় একসময় বিক্রি করে দেন নদীয়ার রাজাকে। চড়া দামে । ঘর বিক্রয়ের টাকা একমাত্র শ্যালক সুরেনকে ব্যবসা শুরু করার জন্য ধার দেন। সুরেনের ব্যবসা লাটে ওঠে। অর্থ কষ্টে পড়েন এই সারস্বত -দম্পতি। একপ্রকার বাধ্য হয়ে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন তাঁরা।

এদিকে প্রয়াত হন রবীন্দ্রনাথ। ‘পুনশ্চ’ হয়ে ওঠে স্থায়ী ঠিকানা। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে বিপর্যস্ত হন তাঁর আদরের ভ্রাতুস্পুত্রী। যে ‘বিবি’ (ডাকনাম) কে প্রাণ খুলে ছিন্নপত্রাবলী উপহার দিয়েছেন কবি। শুরু করেন প্রমথ চৌধুরীর আত্মকথার ধারাবাহিক অনুলিখন। ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় যা ধরা আছে ক্রমান্বয়ে।
১৯৪৬এর দাঙ্গায় যখন কলকাতা সন্ত্রস্ত ও মুহ্যমান , চলে গেলেন ‘বীরবল’। ‘শ্রুতিও স্মৃতি’ র লেখিকা বাকি জীবনটা কাটিয়ে গেলেন দুই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের স্মরণযন্ত্রণায় ।

- Advertisement -
Latest news
Related news