Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৭৫ ।। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

ভাষাচার্য
সুনীতিকুমার বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

নববধূর শ্বশুরবাড়িতে পদার্পণের পর দাসিবৃত্তির ঐতিহ্য গোঁড়া হিন্দু পরিবারে দীর্ঘ চর্চিত। তিনি তা প্রকাশ্যে লঙ্ঘন করেন। প্রায়শঃই পুত্রবধূকে বলতেন – ‘সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব:’। শ্বশুরবাড়িতে সম্রাজ্ঞীর মতো বিরাজ করো। তিনি সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় (২৬ নভেম্বর ১৮৯০ – ২৯ মে ১৯৭৭)।
বাবা হরিদাস চট্টোপাধ্যায়, মা -কাত্যায়নী দেবী। বাড়ি কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে। তবে সুনীতিবাবুর জন্ম হাওড়ার শিবপুরে, মামাবাড়িতে। অসাধারণ মেধাবী এই মানুষটি স্কটিশ চার্চ কলেজ , প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম. এ. পাশ করেন। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি অর্জন করেন।জুবিলি গবেষণা পুরস্কার লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন বিদ্যাসাগর কলেজে , ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে। ১৯১৪ থেকে দীর্ঘ জীবন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় ব্রতী ছিলেন ।

মাঝখানে দু’বছর (১৯১৯ –২১) লন্ডনে যান ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার কাজে। তখন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পি. এইচ. ডি. ছাড়া সরাসরি ডি.লিট করা যেত না। মুশকিলে পড়েন সুনীতি কুমার। এমন সময় প্রখ্যাত গবেষক জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন রাম শর্মা তর্কবাগিশের ‘প্রাকৃত কল্পতরু’ গ্রন্থের সম্পাদনায় রত ছিলেন। ঘটনাচক্রে তাঁর গবেষণা কর্মে সহায়তা করেন সুনীতিকুমার। এবার সেই গ্রিয়ার্সন সাহেব লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান, সুনীতিকুমারের এই কাজকে তাঁর পি. এইচ.ডি. সমতুল্য মর্যাদা দেওয়া হোক।এবার ডি. লিট.সম্পন্ন করলেন সুনীতিবাবু। বহু বছর পরে তিনি যখন বিশ্ববন্দিত ভাষাতাত্ত্বিক, তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর হাতে আসে নদীয়ার একটি স্কুলের বীরেন বিশ্বাস নামে জনৈক প্রধান শিক্ষক রচিত গ্রন্থ ‘রবীন্দ্র শব্দকোষ।’ পাঠ মুগ্ধতায় সুনীতিকুমার ঐ লেখককে ডেকে লেখাটি থিসিস হিসেবে জমা দিতে বলেন এবং শ্রী বিশ্বাস ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

সারাজীবনে তিনি তিনশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। ভাষাতত্ত্ব ,ধ্বনিতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, নাটক, সংগীত, চিত্রকলা, ভ্রমণ-সাহিত্য নানা ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন স্বচ্ছন্দে। গবেষণার কেন্দ্রে ছিল ইন্দো আরিয়ান ফিলোলজি। বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত গ্রন্থ ODBL(The Origin and Development of Bengali Language) তাঁকে বিশ্ববন্দিত ভাষাবিজ্ঞানীর সম্মান ও পরিচিতি এনে দিয়েছে। গ্রন্থটি তিনখণ্ডে বিধৃত । অধ্যাপক ড্যানিয়েল জোনসের তত্ত্বাবধানে এই গবেষণা নিষ্পন্ন করেন তিনি ।
পাকেচক্রে নানা কাজে জড়িয়ে থাকতে হতো তাঁকে। বহু বিশিষ্ট মানুষের সান্নিধ্যে থাকবার ফলে সেসব করতেন অন্তর থেকে। স্যার আশুতোষ ছাড়াও দুই বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গসুধা পান করেছেন অক্লেশে। একজন বাংলা রঙ্গালয়ের নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী। অন্যজন, রবীন্দ্রনাথ। চন্দ্রগুপ্ত নাটকের মঞ্চায়নে বিশেষ ভূমিকা ছিল সুনীতিবাবুর। তিনি এই নাটকের পোষাক পরিকল্পনার দায়িত্ব নেন।

রবীন্দ্রনাথ ১৯২৭ সালে চারজন ভ্রমণসঙ্গী সহ বিদেশযাত্রা করেন। তাঁদের অন্যতম সুনীতিকুমার। সেবার জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর যান তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের ‘যাত্রা’ গ্রন্থে সেই বিবরণ বিধৃত। ভ্রমণকালে ভারতীয় শিল্প সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথের আদর্শ বিষয়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সুনীতিবাবু। রবীন্দ্র সংগমে, দ্বীপময় ভারত, World Literature and Tagore প্রভৃতি গ্রন্থে সুনীতিবাবুর রবীন্দ্র চর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাংলাভাষা পরিচয় গ্রন্থটি সুনীতি কুমারকে উৎসর্গ করেন। এই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি ভাষাচার্য অভিধায় ভূষিত করেন, যা আজ বুধজন স্বীকৃত। শেষের কবিতা উপন্যাসের নায়ক অমিত রে শিলংএ বেড়াতে গিয়ে কোনো সাধারণ গল্প উপন্যাস নয় সুনীতিবাবুর বই পড়ায় ব্যস্ত ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা হল, যা থেকে বোঝা যায়,রবীন্দ্র মননে এক অনন্য আসনে স্থায়ী ছিলেন সুনীতিবাবু।

সন-তারিখ ও সম্মানের পরিধিতে তাঁর অবদান বিচার সম্ভব নয়। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি সযত্নে আড়াল করতেন সে সব। রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো হন তিনি। হিন্দি ভাষাচর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য এলাহাবাদে আয়োজিত হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য বাচস্পতি উপাধি প্রদান করা হয় তাঁকে। লন্ডনের সোসাইটি অফ আর্টস এন্ড সায়েন্স এর সদস্য হন তিনি। অর্জন করেন অসলোর নরওয়েজিয়ান একাডেমির সভ্যপদ। ভারত সরকার প্রদান করে পদ্মবিভূষণ (১৯৬৩)। জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান পান (১৯৬৬)। সাহিত্য অকাদেমির সভাপতি পদ অর্জন করেন (১৯৬৯)। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ইন্দিরা গান্ধী প্রদান করেন ‘দেশিকোত্তম’ সম্মান।
সংস্কারমুক্ত গোঁড়ামিহীন মানুষটি তারুণ্যে কিছু সময়ের জন্য বিচলিত হলেও আজীবন ধর্মনিরপেক্ষ মননশীলতায় ব্যাপৃত ছিলেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁকে একাধিকবার জাতীয় প্রয়োজনে স্মরণ করেছেন। এমনকি অধুনা লুপ্ত, তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের অধ্যক্ষ হিসেবে দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন (১৯৫২- ৫৮) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।

ভূয়োদর্শী মানুষটি ঠাকুর ঘরে দৈনন্দিন গীতা পাঠ করতেন। সোচ্চারে শিবস্তোত্র উচ্চারণ করতেন। তাঁর বসতবাটি ‘সুধর্মা’ র ঠাকুর ঘরটি ছিল দর্শনীয়। সেখানে গীতা উপনিষদের পাশে ঠাঁই পেয়েছিল বাইবেল, কোরান। সেখানে বসেই বাড়ির ছোটদের শোনাতেন হোমার, গ্রীক নাটক, রবীন্দ্র সাহিত্য। প্রখ্যাত সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব প্রয়াত হলেন। তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন সুনীতিকুমার। সেখানে তাঁর কণ্ঠে ‘গায়ত্রী’ মন্ত্র উচ্চারিত হলে নরেন্দ্রদুহিতা নবনীতা দেবসেন বিস্মিত হন। অব্রাহ্মণ অথচ প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের জন্য গায়ত্রী জপ শাস্ত্রবিরোধী নয় বিধান ছিল তাঁর।
তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল নব্বই বছর বয়সের পর ‘বাণপ্রস্থ’ নেওয়ার। সেজন্য ত্রিসূত্র রচনা করেন নিজে। ভারত স্মরণং গচ্ছামি , ধর্ম স্মরণং গচ্ছামি, রবীন্দ্র স্মরণং গচ্ছামি। যা অপূর্ণ থেকে যায় সুনীতিকুমারের। ১৯৭৭’ এর মে মাসের ২৯ তারিখে প্রয়াত হন ।

- Advertisement -
Latest news
Related news