Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১০৩।। সারদামণি দেবী।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

করুণাময়ী
সারদামণিবিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

“সত্যিকারের মা ,গুরুপত্নী নয় ,পাতানো মা নয় ,কথার মা নয় – সত্য জননী”। তিনি শ্রী শ্রী মা সারদামণি (১২/১১/ ১৮৫৩ — ২০/৭/১৯২০)।                                                                      শিবরানী সেন তাঁর “পদ প্রান্তে” গ্রন্থে সুললিত ভাষায় মায়ের ঐহিক রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন – ‘মায়ের মাথায় ছিল একরাশ কালো চুল ,আর সে চুল কি সুন্দর। মা নিজে যেমন গভীর ঠিক যেন তেমনি গভীর মায়ের মাথার চুল। …. মায়ের পা দুটি ছিল খুব সুন্দর। পায়ের তলায় পদ্ম ফুলের রক্তাভা। পায়ের গড়নও ছিল খুব সুন্দর। মুখের গড়ন ছিল ভারি মিষ্টি; চোখ নাক ছিল অপূর্ব । করুণা আর মমতায় মাখা ছিল মুখ , মায়ের চোখ দুটি ।’

সারদাদেবী জন্মেছিলেন বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার জয়রামবাটী গ্রামে। বাবা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মা -শ্যামাসুন্দরী দেবী। জন্মের পর নাম দেওয়া হয় ক্ষেমঙ্করী। পরে তা পাল্টে সারদামণি রাখা হয়। যদিও রাশি আশ্রিত নাম – ঠাকুরমণি। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলনা তার। তবে ভাইদের সাথে মাঝে মাঝে পাঠশালা চলে যেত। তাদের পাশে বসে দেখে শুনে সামান্য অক্ষর জ্ঞান অর্জিত হয়।
মাত্র ছয় বছর যখন তার বয়স , বিয়ে হয়ে যায় গদাধরের সংগে। সেটা ১৮৫৯ সাল। তখন ছিল বরপক্ষের থেকে পণ দেওয়ার যুগ। বিয়ের রাতে গদাধরের বাড়ির তরফ থেকে তিনশো টাকা মুদ্রাপণ দেওয়া হয়। স্বামীর কাছে দক্ষিণেশ্বরে যান অনেক পরে। ১৮৭২ সালের ২৩ মার্চ। বাবা রামচন্দ্র মেয়েকে জামাই এর কাছে দিয়ে এসেছিলেন।                 ১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণ প্রয়াত হন। তবে বৈধব্যবেশ গ্রহণ করেননি সারদা মা। স্বামীর নিষেধ ছিল যে !

ছোটবেলা থেকেই সেবা পরায়ণতা ছিল তার সহজাত গুণ। যখন তিনি কিশোরী, জয়রামবাটিতে একবার ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। সাধারণ গরিব ক্ষুধার্ত মানুষের মৃত্যু মিছিল দেখে কাতর হয়ে যান সারদামণি। বড়দের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে ক্ষুধার্তদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন, খাদ্য প্রদান করেন। বাড়িতে ভিক্ষুক এলে কাউকে ফেরাতেন না। নিজের হাতে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াতেন। পাশে বসে হাত পাখায় পীড়িতদের বাতাস করতেন।

অসম্ভব মানসিক জোর আর বুকে সাহস ছিল, মায়ের। তাই হাসি মুখে রামকৃষ্ণের সব ওজর- আবদার মেনে নিয়েছেন। যেকোনো দুর্যোগে পাশে থেকেছেন। স্বামীর প্রয়াণের পর মঠ ও আশ্রমের সেবার কাজে আত্ম নিয়োগ করেছেন। সবার সাথে মানিয়ে নিয়েছেন। কথিত আছে , একবার অন্ধকার পথে একাকিনী সারদামণি ডাকাতের দ্বারা আক্রান্ত হন। তবে ঠান্ডা মাথায় তাদের মোকাবিলা করেন। বলেন -‘আমি তোমার মেয়ে সারদা’। এই কথায় সম্মোহিত হন ডাকাতদলের সর্দার। তিনি সসম্মানে সারদার ফেরার ব্যবস্থা করেন। আজীবন বহু শঠ – প্রবঞ্চক ও তস্করের অন্ধকার জীবনে আলোর দিশা ছিলেন সারদামণি।

১৮৮৮ সালে পুরী ধামে তীর্থ সেরে আসেন। রামকৃষ্ণের প্রয়াণের পক্ষকাল পরে লক্ষ্মীদেবী , গোপাল মা সহ ঘনিষ্ঠ গৃহী ও সন্ন্যাসী শিষ্যদের নিয়ে তীর্থ দর্শনে যান । অযোধ্যা কাশী ও বৃন্দাবন ঘুরে আসেন। সংঘের ইতিহাসে আছে এই বৃন্দাবন ধামেই প্রথম নির্বিকল্প সমাধি হয় সারদা মায়ের।

ফিরে এসে কামারপুকুরে যান শ্বশুরের ভিটেতে। দারিদ্র্য ও দুঃখ কষ্টে দিন কাটছিল সেখানে। খবর পেয়ে প্রিয় শিষ্য শরৎ (সারদানন্দ ) হাজির হন। মাকে ফিরিয়ে আনেন কলকাতায়। মায়ের বাটিতে প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৮৮)। উদ্বোধন পত্রিকার কার্য্যালয় এটাই। জাতপাতের ঊর্ধ্বে এক আনন্দময় জগৎ নিজের মতো করে গড়ে তোলেন শ্রীমা। একবার আমজাদ নামে জনৈক ব্যক্তিকে দুপুরে নিজের হাতে খেতে দেন মা। তারপর তার এঁটো পরিষ্কার করেন। সেই দেখে উপস্থিত ঘনিষ্ঠরা কেউ কেউ সামান্য উষ্মা প্রকাশ করেন, মায়ের কাছে। মা বলেন ,’ আমার শরৎ যেমন ছেলে , ওই আমজাদও তেমন ছেলে।’ একুশ শতকের বাংলায় এই ঘটনা মামুলি মনে হতে পারে , কিন্তু উনিশ শতকের শেষে এর অভিঘাত যথেষ্ট তাৎপর্যময় ছিল। আজ যখন দেশ জুড়ে নতুন করে জাতপাতের উস্কানি দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ ও হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা চলছে অহরহ, তখন মায়ের শিক্ষা আমাদের পাথেয় হয়ে ওঠে।
অতি সাধারণ এক পল্লীবালিকা থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংঘজননী। পরমহংসের ভক্তদের কাছে বিশ্বজননী। সারদার চরিত্রের মহত্তর দিক ছিল – তাঁর অপার মাতৃস্নেহ। এক শাশ্বত মাতৃপ্রেম অন্তরে সদা জাগরূক হয়ে সক্রিয় থেকেছে। তাই তিনি সকলের মা। ক ‘জন সাহস করে আজ উচ্চারণ করতে পারেন -‘ আমি সৎ এরও মা অসৎ এরও মা’। বিশ্বব্যাপ্ত রামকৃষ্ণ অনুগামীদের কাছে তিনি আজ শ্রী শ্রী মা। মহাশক্তির আধার রূপে দেশে দেশে পূজিত হন। নিখিল , বীরেশ্বর , অশেষ, বিরজানন্দ প্রমুখ সারদা মায়ের জীবন ও বাণীকে ছড়িয়ে দিতে আজীবন কাজ করে গেছেন।

সারদা মাকে নিয়ে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত। একবার এক ভক্ত মাকে প্রশ্ন করেন -মা ,আমাদের দেশ কবে স্বাধীন হবে ? মা সর্ব সমক্ষে তাঁকে বলেন ,’ বাবা তোমরা কি তাদের দেশ থেকে তাড়াতে পারবে ? তা পারবে না । যখন ওদের নিজেদের মধ্যে লড়াই লাগবে তখন তোমরা স্বাধীন হবে’। নিজে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেননি । তাঁর প্রিয় সন্তান বিবেকানন্দও লেখালেখি এবং বাগ্মিতায় নিজেকে সীমায়িত রেখেছিলেন। তবে ভগিনী নিবেদিতা স্বচ্ছন্দে ওই জগতের অনেকের সাথে কাজ করেছেন। মা নিজে বঙ্গভঙ্গ প্রয়াস দেখেছেন , দেখেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পাখসাটও ।তার ভিত্তিতে এই জাতীয় বিশ্লেষণ তাঁর দূরদর্শিতার পরিচায়ক।

আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী দুনিয়ায় সারদা মায়ের বাণী আমাদের চরিত্র গঠনে সহায়ক হতে পারে। বাঙালির সামাজিক মূল্যমান যখন ক্রম ক্ষয়িষ্ণু, তখন পথ দেখান শ্রী শ্রী মা। আটপৌরে জীবনের অলিন্দে তিনি যা উপলব্ধি করেছেন , তার ইতিবাচক দিক গুলি বাণী হয়ে ঝরে পড়েছে প্রাত্যহিক দিনযাপনে। সেই সব অসংখ্য মণিমুক্তোর কয়েকটি চয়ন করা যায়-
১। পৃথিবীর মতো সহ্য গুণ চাই। পৃথিবীর ওপর কত রকমের অত্যাচার হচ্ছে , অবাধে সব সইছে, মানুষেরও সেই রকম চাই ।
২। উচিত কথা গুরুকেও বলা যায় তাতে পাপ হয়না ।
৩। জগতে যত অনর্থের মূল টাকা।
৪। মন্দ কাজে মন সর্বদা যায়। ভালো কাজে মন এগোতে চায় না। সেজন্য ভালো কাজ করতে গেলে আন্তরিক খুব যত্ন ও রোখ চাই ।
৫। খুঁটিনাটি নিয়ে মনকে বিচলিত করবে না ।
৬। ভাঙতে সব্বাই পারে গড়তে পারে কজন ? নিন্দা ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই কিন্তু ভালো করতে পারে কজন ?
৭। সত্য কথা হলেও অপ্রিয় করে বলতে নেই ।
৮। সংযমে মানুষ দেবতা হয় ।
৯। পরের দোষ দেখোনা ।দোষ দেখবে নিজের (শেষ বাণী )।
১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে মা শেষ বারের জন্য পিতৃভূমি জয়রামবাটীতে যান। প্রায় এক বছর ছিলেন সেখানে। ১৯২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ অশক্ত মাকে কলকাতায় আনা হয়। পাঁচ মাস রোগে পীড়িত ছিলেন মা। খুব কষ্ট পেতেন সে সময়। অবশেষে ৪ঠা শ্রাবণ (১৩৩৭) বঙ্গাব্দ রাত দেড়টার সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেলুড় মঠে গঙ্গার তীরে সম্পন্ন হয় সারদা মায়ের শেষকৃত্য। যেখানে এখন সারদা মায়ের সমাধি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।

- Advertisement -
Latest news
Related news