Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৯৫।। দীনেশচন্দ্র সেন।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

মননশীল চিন্তাবিদ
দীনেশচন্দ্র সেন

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

                                                                বিনোদ মন্ডল  ঋদ্ধ বাংলা সাহিত্যে সমালোচনা মূলক বিশ্লেষণের ধারায় পুরোধা ব্যক্তিত্ব পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন (০৩.১১. ১৮৬৬ — ২০.১১.১৯৩৯)। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে তথ্যনিষ্ঠ অভিজ্ঞান ও তার্কিক মননশীলতার সমন্বয়ে সমালোচনা সাহিত্যকে ভিন্নতর মাত্রা প্রদান করেছেন তিনি। বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও তার উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি ছিলেন তাঁর সমকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ।
অধুনা বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার বগজুড়ি গ্রামে জন্ম তাঁর। আদতে ঢাকার মানুষ ছিলেন তাঁর বাবা। ঈশ্বরচন্দ্র সেন। মানিকগঞ্জ আদালতে ওকালতি করতেন। তাই সেখানে গিয়ে বসবাস। মায়ের নাম রূপলতা দেবী। বিদ্যালয় জীবনে সাধারণ মানের ছাত্র ছিলেন। সেই সব কাহিনী সভা সমিতিতে রসিয়ে রসিয়ে বলতেনও নির্দ্বিধায়। ১৮৮২ সালে তিনি যেবার এন্ট্রান্স পাশ করেন তাঁর সহধ্যায়ী ব্ন্ধু সাতবার ফেল করার পর শিক্ষকদের বলেছেন – ‘আমরা ফেল হইয়াছি, তাহাতে দুঃখ নাই, কিন্তু দীনেশও পাশ করিল’। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে এফ. এ.(১৮৮৫) এবং ১৮৮৯ সালে বি. এ. ডিগ্রি লাভ করেন দীনেশচন্দ্র সেন।
কালক্রমে তাঁর ললাটে নানা উপাধি ভূষিত হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার , অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, লোকসাহিত্য বিশারদ, এবং রায়বাহাদুর। যখন তিনি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন, তখন একটা নোটবুকে লিখেছেন -“বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হইব, যদি না পারি ঐতিহাসিক হইব। যদি কবি না হওয়া প্রতিভায় না কুলায়, তবে ঐতিহাসিকের পরিশ্রমলব্ধ প্রতিষ্ঠা হইতে আমায় বঞ্চিত করে, কার সাধ্য?” ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত সাহিত্যের ইতিহাসমূলক গ্রন্থ -‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’। কবি হওয়ার স্বপ্ন তাঁর নিজের পূরণ করা সম্ভব হয়নি; তবে সেই সাধ পূর্ণ করেছেন – বংশের উত্তর পুরুষ। উজ্জ্বল প্রতিভাধর আধুনিক কবি সমর সেন ছিলেন তাঁর নাতি।

সিলেটের হবিগঞ্জ স্কুলে(১৮৮৭) শিক্ষকতা শুরু করেন দীনেশচন্দ্র। সেখান থেকে যান কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইনস্টিটিউশনে (১৮৮৯)। এরপর ১৮৯০ সাল নাগাদ ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে বৃত হন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছাত্র সংগ্রহের সাথে সাথে পুরনো পুঁথি ও লোকগীতি সংগ্রহ নেশায় দাঁড়িয়ে যায়। কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের নবরূপকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় জহুরি ছিলেন। তিনি দীনেশচন্দ্রকে রিডার পদে নিয়োজিত করেন। নির্বাচিত হন ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলো।’ আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

দীনেশচন্দ্রের ইচ্ছে ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন স্কুলে শিক্ষকতা করবেন। বিদ্যাসাগরের কাছে যানও। কিন্তু বাঙাল দীনেশচন্দ্রকে সেদিন ব্যঙ্গ করে ফিরিয়ে দেন বিদ্যাসাগর। নিজের লেখায় সখেদে তিনি বলেছেন “তুই যে বাঙাল…….এখনকার ছাত্ররা ভিক্টোরিয়া স্কুলের ছাত্র নয় যে তুই অনার্স পাস শুনিয়া চমকিয়া উঠিবে……. তোকে তো একদিনে পাগল করিয়া ছাড়িবে। “(ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য)।
একইভাবে দীনেশকে অবজ্ঞা করেছেন অন্য এক যুগন্ধর, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রও। সাহিত্য নিয়ে আলাপ আলোচনার জন্য তাঁর বাড়িতে যান তিনি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে সাহিত্য আলোচনার জন্য লায়েক ভাবেননি সেদিন। পূর্ববাংলার কোথায় কোন কোন শস্য উৎপন্ন হয়, সেসবের দাম-দর জাতীয় আলোচনা চালিয়ে যান। বিদায় করেন। এই দুই মহামনীষীর ব্যবহারে আহত হয়েছেন কিন্তু হতাশ হননি। বরং ইতি কর্তব্যের অভিমুখে দৃঢ়তার সংগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

সেকালে ‘সৌরভ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন চন্দ্রকুমার দে। তাঁর সহায়তায় দীনেশচন্দ্র পুঁথি সম্পাদনার কাজে নিরলস ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, সাধ্যমতো পরামর্শ দিয়েছেন। উত্সাহিত করেছেন। দিকপাল হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ পাঠের প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন ‘ডিসকভারি অব আওয়ার লিটারারি হেরিটেজ।’
আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে অখণ্ড বঙ্গজীবনের অঙ্গনে প্রকীর্ণ মণিমুক্তোরাজি চয়ন করেছেন। প্রকাশ করেছেন। ১৯০৫ সালে বিনোদ বিহারী কাব্যতীর্থের সহযোগিতায় শ্রীকর নন্দী বিরচিত ‘ছুটি খানের মহাভারত’ পুঁথি প্রকাশ করেন। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সহযোগিতায় মানিক গাঙ্গুলীর লেখা ‘শ্রী ধর্মমঙ্গল পুঁথি’ প্রকাশ করেছেন। ১৯১১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর অসামান্য গ্রন্থ” হিস্ট্রি অব বেঙ্গলী লিটারেচর।” যশস্বী প্রাচ্যবিদ ও গবেষক স্যার জর্জ গ্রিয়ার্সন তাঁর ‘মানিকচন্দ্র রাজার গান’ পাঠ করে মুগ্ধ হন। গ্রন্থটি এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশ করেছিল।
বঙ্গসমাজ ও সাংস্কৃতির নানা প্রান্তরে তাঁর অনায়াস যাতায়াত ছাপ ফেলেছে ইতিহাস চর্চায়। প্রায় চল্লিশখানি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিগুলি হল রামায়নী কথা (১৯০৪) ,বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় (১৯১৪, ২খণ্ড), গোপীচন্দ্রের গান, সরল বাঙ্গালা সাহিত্য (১৯২২), বৈদিক ভারত (১৯২২), দীনেশ সেনের ছোট গল্প (১৯২৫), ওপারের আলো (১৯২৭), পৌরাণিকী (১৯৩৪), বৃহৎ বঙ্গ (১৯৩৫, ২ খণ্ড), পদাবলী-মাধুর্য (১৯৩৭), পুরাতনী (১৯৩৯) ,বাংলার পুরনারী (১৯০৯) ,প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান (১৯৪০), হিন্দু সমাজ ও বৈষ্ণবধর্ম, ময়মনসিংহ গীতিকা,পূর্ববঙ্গ গীতিকা (৪খণ্ড) ইত্যাদি। বাংলার বাঘ অাশুতোষের প্রতি বিনম্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লিখেছেন আশুতোষ স্মৃতি কথা (১৯৩৬)। এছাড়াও স্মরণীয় তিনটি সম্পাদিত গ্রন্থ হল: গোবিন্দ দাসের কড়চা, কৃষ্ণকমল গ্রন্থাবলী, কবিকঙ্কন চণ্ডী (২খণ্ড)।

কলকাতায় বসবাসের ফলে শিকড় ছাড়া হওয়ার যন্ত্রণা আমৃত্যু তাঁকে বিদ্ধ করেছে। ৬৯ বছর বয়সে ঢাকায় আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান রায় বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। উদ্বোধন করে একটি অসামান্য বক্তৃতা দেন দীনেশচন্দ্র। সুদীর্ঘ আলোচনার উপান্তে সেদিন বলেছিলেন ‘আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমির গৌরব এমন নিষ্প্রভ কিন্তু সে শিখা এখনও নিবিয়া যায় নাই ,নতুবা পরমহংসদেব, কেশবচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, আশু মুখোপাধ্যায় ,জগদীশ বসু, প্রফুল্ল রায় এদেশে জন্মগ্রহণ করিলেন কী রূপে?……জাতীয় আদর্শ কী, ইতিহাস চর্চা দ্বারা তাহা সম্যক অবহিত হইয়া আমাদের ভাবী সমাজ যেন জীবনপণ করিয়া তপস্যায় নিরত হয়, তবেই এই আকাশে আবার তরুণ সূর্যের কিরণ ও চাঁদের আলো ফুটিয়া উঠিবে।
আশাতুর মানুষটির তথ্যনিষ্ঠতা নিয়ে যথার্থ পণ্ডিত-কয়েকজন গবেষক সমালোচনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য দুটি নাম-সুকুমার সেন এবং নন্দগোপাল সেনগুপ্ত। জসীমউদ্দীন প্রাথমিক ভাবে কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করলে ও পরে তাঁর সান্নিধ্যে এসে নিজের মত পরিবর্তন করেছেন। তাঁর কর্মস্থল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট. উপাধি (১৯২১) ও জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে (১৯৩১) ভূষিত করেছে। (১৯২১) সালে উপনিবেশিক সরকার রায়বাহাদুর খেতাব প্রদান করেছে। কথিত আছে লেখার টেবিলে সক্রীয় থাকাকালীন প্রয়াত হয়েছিলেন আচার্য্য দীনেশচন্দ্র সেন। শব যাত্রার পূর্বে প্রত্যক্ষদর্শীগণ তাঁর তর্জনীতে কালির রেখা দেখে অসীম শ্রদ্ধায় প্রণত হয়েছিলেন ।

- Advertisement -
Latest news
Related news