Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৯৪ : ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

বর্ণময় কর্মবীর
ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে যখন চরম নৈরাজ্য বিরাজমান, তখন তাঁকে সবার আগে স্মরণ করতে হয়। আজ থেকে একশো বছর আগে এই দূরদর্শী শিক্ষা সংগঠক ঘোষণা করেছিলেন –‘ সরকারি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গোলদিঘির গোলামখানা।’ তিনি ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় (১১.০২.১৮৬১– ২৭.১০. ১৯০৭)।  আসল নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্মেছিলেন হুগলী জেলার খন্যান গ্রামে। হুগলী কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশুনার পর ভর্তি হন কলকাতার জেনারেল এসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে। এমন সময় সমাজসেবার তাগিদে কলেজ ত্যাগ করেন। ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের কাজে, দশের মধ্যে। প্রখ্যাত চিন্তক অধ্যাপক বিনয় সরকার তাঁর মূল্যায়ণ করতে গিয়ে বলেছেন -‘ ব্রহ্মবান্ধব একজন জবরদস্ত, স্বার্থত্যাগী ও নির্ভীক কর্মবীর। লোকটা ডানপিটে,ত্যাঁদড় আর ভবঘুরে।’

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পথিকৃৎ বলা হয় তাঁকে। তাঁর চরিত্রের নানা দিগন্ত আজও অনালোকিত ও অনালোচিত রয়েছে। তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের বাল্যব্ন্ধু, রবীন্দ্রনাথের পরম সুহৃদ। ধর্ম সম্পর্কে চির-চঞ্চলিত প্রাণ।তারুণ্যে ছুটে যান রামকৃষ্ণের কাছে। যুগধৃত ধর্ম ও তার স্বরূপ সন্ধানে চিরব্যাপৃত ছিলেন তিনি। ব্যক্তি ও বিশ্ব, সৃষ্টি ও স্রষ্টা সম্পর্কে নিরন্তর অনুধ্যান ছিল তাঁর চির জিজ্ঞাসু মনে। দীর্ঘ কিছুটা সময় প্রাজ্ঞ কেশব চন্দ্র সেনের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন তিনি।

কেশব বাবুর পরামর্শে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত(১৮৮৭) হন, মানুষটি। নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের এই তরুণ সংগঠক ধর্ম প্রচারের কাজে সিন্ধুদেশে যাত্রা করেন। তাঁর কাকা রেভারেন্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রোমান পাদরীদের প্রভাবে অচিরেই ব্রাহ্মধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। প্রথমে প্রোটেস্ট্যান্টদের দলে কাজ শুরু করেন। পরে রোমান ক্যাথলিকদের সংগে মনের মিল খুঁজে পান।
অন্য হিন্দুদের মতো খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেই থেমে থাকেননি তিনি। শুরু করেন নিরন্তর পড়াশুনা। ধর্ম প্রচারের কাজে স্বকীয় পন্থা অন্বেষণে মেতে ওঠেন। ক্যাথলিক সন্ন্যাসী হিসেবে সাধারণ জীবন যাপন, গৈরিক বস্ত্র ধারণ তাঁকে অভিনব রূপ দান করে। ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারের জন্য জব্বলপুরে নর্মদা নদীর তীরে বিশাল একটি মঠ ও আশ্রম গড়ে তোলেন। তাঁর এই ভারতীয় ঘরানায় ক্যাথলিক ধর্ম প্রচারের পদ্ধতিতে আকৃষ্ট হন বহু মানুষ। বলা হত, ব্রহ্মবান্ধব হলেন ঈশাপন্থী হিন্দু সন্ন্যাসী।

এতদিন এইসব কর্মকাণ্ড চলছিল ভবানীচরণ নামেই। এবার তাঁর দার্শনিক জীবনের মোড় ঘুরে যায়। বিবেকানন্দের সংস্পর্শে নতুন করে উন্মীলিত হন তিনি। সেটা ১৯০১ সাল। ফিরে আসেন হিন্দু ধর্মে। তখন নবলব্ধ নাম হয় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। ১৯০২ সালে স্বামীজীর মহাপ্রয়াণের পর ২৭ টাকা এবং একটিমাত্র কম্বল সম্বল করে বিলেত যাত্রা করেন। বেদান্ত ধর্মের প্রচারে। পাশ্চাত্যে নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেদান্তকে সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় প্রচার করে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বনের বেদান্তকে ঘরের বেদান্তে রূপান্তরিত করেন ব্রহ্মবান্ধব। অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত বিভিন্ন কলেজের সভায় হিন্দু ধর্ম প্রচার করে রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি।
জীবন সায়াহ্নেও ধর্ম নিয়ে তাঁর তুমুল মাতামাতির অন্ত ছিলনা। কালীঘাটের কালী মন্দিরে ধ্যানে বসতেন তিনি। রীতিমতো হিন্দু শুদ্ধাচার অনুসরণ করে প্রায়শ্চিত্ত সেরে হিন্দু ধর্মে ফিরে আসেন। তাঁর এই ধর্মীয় পদক্ষেপে নিজে একা নয় আলোড়িত হতেন আত্মীয় স্বজন,ব্ন্ধু বান্ধবরাও । তাই স্বামীজীর অগ্রজ মনস্বী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর স্মৃতিচারণ করে বলেছেন -‘উপাধ্যায়জী আজ ও আমাদের দেশে misunderstood হইয়া আছেন।’

রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্যাশ্রম ও শান্তিনিকেতন গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞে প্রথম যুগের অন্যতম কান্ডারী ছিলেন তিনি। ১৯০০ সাল নাগাদ উভয়ের পরিচয় ঘটে। ব্রহ্মবান্ধবের বন্ধু কার্তিক লালের বেথুন রো’ র বাড়িতে মাঝেমাঝেই যাতায়াত ছিল রবীন্দ্রনাথের। তখন তাঁর মনেও হিন্দুধর্মের নানা দিক নিয়ে আকুলতা জায়মান ছিল । সমকালে লেখা ‘নৈবেদ্য’ কাব্যের কবিতা ও অন্যান্য প্রবন্ধে তার স্পষ্ট ছাপ আছে। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন তিনি। সংগে আসেন তাঁর নিত্য সহচর এক সিন্ধি শিষ্য রেবাচাঁদ। সূচনাকালে যে দশজন ছাত্র যুক্ত হয়, তাদের আটজনই ব্রহ্ম বান্ধবের আহ্বানে আশ্রমে শিক্ষার্থী হিসাবে যোগদান করে। বাকী দুজন রবীন্দ্রনাথের দুই ছেলে রথীন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথ।

১৯৩৩ সালে পাশ্চাত্য ইতিহাসকার ও শিক্ষাবিদ এইচ.সি. ই. জাকারিয়াস এর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নাম -‘রেনাসেন্ট ইন্ডিয়া- ফ্রম রামমোহন টু মোহনদাস গান্ধী’। এই গ্রন্থে গ্রন্থকার লিখেছেন -‘ব্রহ্মবান্ধবের স্কুলটাই বোলপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং দেবেন্দ্রনাথের আপত্তিতে তাদের আশ্রম ছেড়ে দিতে হয়।’ প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য ১৯০১ সালে কলকাতার সিমলায় শিষ্য রেবাচাঁদকে সংগে নিয়ে প্রাচীন গুরুকুল ঘরানায় বৈদিক আদর্শে ‘সরস্বত আয়তন’ নামে একটি আবাসিক বিদ্যলয় চালু করেছিলেন ব্রহ্মবান্ধব। যদিও রবীন্দ্র অনুসারী অপরাপর চিন্তাবিদরা এ বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী এই মানুষটির সংগে সম্পর্কের নানা টানাপড়েন সত্ত্বেও ১৯০৭ সালে ব্রহ্মবান্ধবের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সম্ভ্রমপূর্ণ সৌহার্দ্য ছিল উভয়ের। ১৯৪১ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ রচনা করেছেন , সেখানেও যথাযথ গুরুত্ব সহকারে এই বন্ধুর ঋণ স্বীকৃত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা অন্য কোনো ধর্মাত্মা ব্যক্তি রবিকে এতো বেশি প্রভাবিত করতে পারেনি। তাই রবি রচনায় বেশ কয়েকটি চরিত্র চিত্রণে গবেষকগণ ব্রহ্মবান্ধবের ছাপ খুঁজে পেয়েছেন।
বিশেষতঃ গোরা, ঘরে বাইরে, চার অধ্যায় উপন্যাস স্মর্তব্য। যথাক্রমে গোরা, সন্দীপ এবং ইন্দ্রনাথ চরিত্রে রক্তমাংসের ব্রহ্মবান্ধব ও তাঁর উতরোল ধর্মাচরণ এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ রবীন্দ্রমননে স্পষ্ট আভাসিত হয়েছে। এসব নিয়ে বহু বিতর্ক ও লেখালেখি বর্তমানে সহজলভ্য। শুধু একটি বিষয় এই প্রসঙ্গে উত্থাপণ করা দরকার। ব্রহ্মবান্ধবই প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ ও ‘গুরুদেব’ অভিধায় ভূষিত করেন।

১৮৯৪–১৮৯৯ সময়কালে করাচিতে থাকবার দিনগুলিতে বেশ কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন তিনি। তারও আগে ইউনিয়ন একাডেমিতে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। গড়ে তুলেছেন ‘কনকর্ড’ ক্লাব, প্রকাশ করেছেন ‘কনকর্ড’ মাসিক পত্রিকা। করাচিতে ‘ফিনিক্স’ ও ‘হারমান’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ‘সোফিয়া’ নামে মাসিক পত্রিকাটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখানেই ১৯০০ সালের ১ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘The World Poet of Bengal’ প্রকাশিত হয়। সেই বিশ্বকবি অভিধা আজ জগদবন্দিত।
স্বামীজীর প্রয়াণের পর রাজনীতিতে যুক্ত হন ব্রহ্মবান্ধব। অগ্নিযুগের পুরোধা হিসেবে দৈনিক সন্ধ্যা পত্রিকায় অগ্নিবর্ষী রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। ফলে প্রকাশের (১৯০৪) চার বছরের মাথায় রাজরোষে ‘সন্ধ্যা’ (১৯০৭) বন্ধ হয়ে যায়। মুদ্রাকরসহ তিনি সম্পাদক হিসেবে কারারুদ্ধ হন। আদালতে ঘোষণা করেন- ‘তিনি ব্রিটিশ কর্তৃত্ব মানেন না’। এই ঘটনা সেকালে স্বাধীনতাকামী বাঙালীর মনে তীব্র দেশপ্রেম জাগ্রত করে।

মামলা চলাকালীন অসুস্থ ব্রহ্মবান্ধবকে ক্যাম্পবেল হাসপাতালে(নীলরতন) ভর্তি করা হয়। দেখা করে যান রবীন্দ্রনাথ। অস্ত্রোপচার করার দিনতিনেক পর ধনুষ্টংকারে মৃত্যু হয় বর্ণময় কর্মবীর ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এর।বিলাতযাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি, ব্রহ্মামৃত, সমাজতত্ত্ব, আমার ভারত উদ্ধার, পালাপার্বণ, প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে তাঁর অন্তরের পাখশাট চিরভাস্বর হয়ে আছে ।

- Advertisement -
Latest news
Related news