Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৮৩।। মীর মশাররফ হোসেন।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

সম্প্রীতির প্রতীক
মীর মশাররফ হোসেন

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

বিনোদ মন্ডল                                                                                                          উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাঙালী মুসলমান সমাজে শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে যাঁরা নিরলস ভূমিকা পালনে এগিয়ে এলেন, তাঁদের অগ্রগণ্য সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন (১৫.১১. ১৮৪৭ — ১৯.১২.১৯১২)। কুসংস্কারমুক্ত, মুক্তমনা এই যুক্তিবাদী মানুষটিকে বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ বলা যায়।
মশাররফ হোসেনের জন্ম কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়ায়। গৌরী নদীর তীরে। বাবা -মোয়াজ্জেম হোসেন। মা- দৌলতুন্নেসা। তাঁর জন্মের সাত পুরুষ আগে বাগদাদ থেকে বঙ্গদেশে আগত পূর্বপুরুষ শাহ সৈয়দ সাদুল্লা ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ‘মীর’ খেতাব লাভ করেন। তাই তিনি পুরো নাম লিখতেন সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন। ছদ্মনাম ছিল গাজী মিয়া। আরবি ফারসি বর্ণমালায় হাতে খড়ি হলেও পরে বাংলা শিখেছেন। শৈশবে মাতৃবিয়োগ হওয়ায় জীবন এলোমেলো হয়ে যায় মীরের। দু দফায় চেষ্টা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনি স্কুলের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেননি ।
তাঁর বাবা ছিলেন সাঁওতা গ্রামের জমিদার। কর্ম জীবন শুরু করেন বাবার জমিদারি দেখাশুনার মাধ্যমে। এরপর ফরিদপুর নবাব এস্টেটে চাকরি নেন। ১৮৮৫ সাল নাগাদ দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজারের পদে আসীন হন। ভাগ্যান্বেষণে কিছুদিন কলকাতায় এসে থেকেছেন (১৯০৩ – ১৯০৯), আবার ফিরে গেছেন পদমদীতে, যেখানে আজীবন বাস করেছেন। চন্দনমৃগীর জমিদার মীর মোহম্মদ আলির সাথে বন্ধুত্বের প্রভাব তাঁর জীবন ও সৃষ্টিতে পরিলক্ষিত হয়।
১৮৬৫ সালে পিতৃব্ন্ধুর কন্যা আজিজুন্নেসার সাথে বিয়ে হয় মীরের। তবে এই বিয়ে সুখের হয়নি। বিচ্ছেদ ঘটে। এর প্রায় একদশক পরে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে কুলসুমকে বিয়ে করেন তিনি। পাত্রের বয়স সাতাশ, পাত্রী বারো। মীরের জীবনীকারগণ লিখেছেন কুলসুম ছিলেন যথার্থ সহধর্মিনী। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির পেছনে কুলসুমের অনুপ্রেরণা ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় লেখকের জীবদ্দশায় মুদ্রিত সর্বশেষ গ্রন্থ ‘আমার জীবনীর জীবনী বিবি কুলসুম।’

গ্রামবার্তার বিখ্যাত সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। বাস্তবে তিনিই ছিলেন মীরের সাহিত্য গুরু। গ্রামবাংলা প্রকাশিকা (১৮৬৩) এবং সংবাদ প্রভাকরে (১৮৩১) মীর নিয়মিত লেখা শুরু করেন। অন্য অনেকের মতো শুরুটা হয় কবিতা দিয়েই। নানা হেঁয়ালি কবিতা, ছড়া ও নিবন্ধের মাধ্যমে।পরিচিতি ঘটে। শুরু হয় পুথি পড়া। যেখানে যাঁর বাড়িতে পুথির সন্ধান পেতেন তা নিয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে যেতেন। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, আত্মজীবনী, ধর্মতত্ত্ব জাতীয় লেখা – সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশটি গ্রন্থ লেখেন মীর ।
যুগধর্ম মেনে অন্যান্য বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকগণ যখন ধর্মীয় বিষয়বস্তু নিয়ে মজে ছিলেন, মীর তখন শুধু ধর্ম সংস্কার নয়, সাহিত্য ও শিল্পের নন্দনতাত্ত্বিক দিকটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, সমানে।

সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহের পটভূমিতে (১৮৭২ -৭৩) তিনি লিখেছেন জমিদার দর্পণ নাটক। কেউ কেউ নামকরণে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রভাবের কথা বলেছেন।
এই নাটকের ভূমিকায় নাট্যকার লিখেছেন ‘ নিরপেক্ষ ভাবে আপন মুখ দর্পণে দেখিলে যেমন ভালো মন্দ বিচার করা যায়,পরের মুখে তত ভালো হয় না। জমিদার বংশে আমার জন্ম,আত্মীয়-স্বজন সকলেই জমিদার , সুতরাং জমিদারের ছবি অঙ্কিত করিতে বিশেষ আয়াস আব্যশক করে না।’ বঙ্গদর্শনে এই নাটকের প্রশংসা করেছেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি লিখেছেন — “জনৈক কৃতবিদ্য মুসলমান কর্তৃক এই নাটকখানি বিশুদ্ধ বাঙ্গালা ভাষায় প্রণীত হইয়াছে। মুসলমানি বাঙ্গালার চিণ্হ মাত্র ইহাতে নাই। বরং অনেক হিন্দুর প্রণীত বাঙ্গালার অপেক্ষা এই মুসলমান লেখকের বাঙ্গালা পরিশুদ্ধ।…..আমাদিগের বলা কর্তব্য যে নাটক খানি অনেকাংশে ভালো হইয়াছে ।”
মীর মশাররফের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা বিষাদসিন্ধু উপন্যাস। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে বেগম করিমুন্নেসার জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার থাকাকালীন তিনখণ্ডে পরিকল্পিত এই গ্রন্থ রচিত হয় (প্রকাশকাল ১৮৮৫, ১৮৮৭, ১৮৯২)।
বিষাদসিন্ধু উপন্যাসটি ধর্মীয় চেতনার ধারক হলেও এর চরিত্রগুলি নিছক ঐতিহাসিক বা যান্ত্রিক পুথিনির্ভর না থেকে রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে উঠেছে। পরাধীন দেশে ভারতবাসীর জাতীয় স্বাধীনতার স্পৃহাকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন লেখক। হোসেন পরিবারের বন্দিদশা থেকে মুক্তির প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়ে শিল্পায়িত করেছেন। লেখক বলেছেন “অমূল্যরত্ন স্বাধীনতা ধন যে স্থানে বর্জিত, সে স্থান অমরপুরী সদৃশ মন ও নয়ন মুগ্ধকর সুখ-সম্ভোগের স্থান হইলেও মানবচক্ষে অতি কদাকার ও জঘন্য। “এখানে এজিদ শাসনকালে বিচার ব্যবস্থার ত্রুটির দিকটির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশের আড়ালে ব্রিটিশ ভারতের বিচার ব্যবস্থার স্বরূপ ও তার দুর্বলতার দিকটিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
কিশোরকালে এই উপন্যাস পাঠের পর কী অনুভূতি হয়েছিল পরবর্তীকালে তার অপরূপ বর্ণনা দিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। ‘সদলবলে কুফায় চলেছেন হোসেন ,হঠাত্‍ তাঁর ঘোড়ার পা গেঁথে গেছে মাটিতে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যেন কর্ণের রথের চাকা। হজরত মহম্মদের ভয়ংকর ভবিষ্যকথন মনে পড়ছে হোসেনের, চারদিক থেকে যেন শব্দ উঠছে ‘হায় হায়’, ‘হায় হায়’, আর গাছে গাছে কুঠারের ঘায়ে শুধু ঝরে পড়ছে রক্ত। ফোরাত নদীর কূল, তৃষার্ত মানুষজনের কাতর অঞ্জলি ,শিশুপুত্রকে নিয়ে গিয়েও এক ফোঁটা জল পাচ্ছে না কেউ, নিষ্ঠুরতার পর নিষ্ঠুরতায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সবাই, লাল হয়ে এল ফোরাতের জল।’ হায় হাসান হায় হুসেন ‘-এর ধ্বনি যেন একটা পটভূমি পেল তার,গল্পের মধ্যে খুলে গেল অপরিচিতের এক দেশ।’

মীরের গো জীবন প্রবন্ধটি তাঁর সমকালে বিরাট সমালোচনার মুখোমুখি হয়। এখানে তিনি লিখেছেন -‘ আমি মোসলমান, গোজাতির পরম শত্রু। আমি গোমাংস হজম করিতে পারি। পালিয়া, পুষিয়া বড় বলদটির গলায় ছুরি বসাইতে পারি, ধর্মের দোহাই দিয়া……পোড়া উদর পরিপোষণ করিতে পারি…..কিন্তু শাস্ত্রে এ কথা লিখা নাই যে ,গো হাড় কামড়াইতেই হইবে, গো মাংস গলাধঃ করিতেই হইবে, না করিলে নরকে পচিতে হইবে’। এখানে তিনি নিছক গো মাংস ত্যাগের প্রস্তাবই শুধু দেননি, বিকল্প হিসেবে ছাগ মাংস ভক্ষণের কথা বলেছেন। পাশাপাশি ইতিহাসের পর্যায় ধরে ধরে নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন।
হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি রক্ষার লক্ষ্যে এই প্রবন্ধে বলেছেন ‘এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু মুসলমান উভয় জাতি ই প্রধান। পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ যে, ধর্ম ভিন্ন, কিন্তু ধর্মে ও কর্মে এক।…..এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যাহাদের সংগে, এমন চির সংগী যাহারা তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কী’? কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। অধিপতি সমাজ ফতোয়া জারি করে। ধর্ম সভা ডাকা হয়। সেখানে তাঁকে কাফের ও তাঁর স্ত্রী কুলসুম বিবিকে হারাম জারি করা হয়। তাঁকে বলা হয় ‘তওবা’ করতে। মর্মাহত লেখক এই নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রথমে মামলা করেন। পরে শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ ও সাহচর্যে আপস মীমাংসায় রাজি হন।

বাঙালি মুসলমান তরুণ সমাজে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন তিনি। ‘আজিজন নেহার ‘(১৮৭৪) এবং ‘হিতকরী’ (পাক্ষিক ১৮৯০) পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একদল সাহিত্যপ্রেমী সংগঠিত হয়েছেন। পাশাপাশি তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য হিসেবেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
সময়ের দিক থেকে এগিয়ে থাকা এই সৎ ও আদর্শবান মানুষটি কতখানি নির্ভীক এবং আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তার পরিচয় বিধৃত রয়েছে আত্মজীবনীর পাতায় পাতায়। স্খলন দুর্বলতা ধামাচাপা দিয়ে নিজেকে দেবোপম গুণের অধিকারী প্রমাণ করেন গড় বাঙালী চরিতকার। মশাররফ সে পথে পা বাড়াননি। অকপটে লিখছেন কৈশোরে এক যুবতী পরিচারিকার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কথা। ‘প্রতিজ্ঞা করিয়াছি সত্য কথা বলিব।দাস, বান্দি কর্তৃকই আমার চরিত্র প্রথম কলঙ্ক রেখায় কলঙ্কিত হয়।’
১৯১০এর ডিসেম্বরে কুলসুম বিবির প্রয়াণের পর ভেঙে পড়েন মশাররফ। প্রিয়তমা পত্নী যে তাঁকে আগলে রেখেছিলেন দাম্পত্যের ৩৬ টি মধুবসন্ত। পদমদীতে কুলসুমের সমাধির পাশে তাঁকে যেন ঠাঁই দেওয়া হয় ,শেষ ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ১৯ ডিসেম্বর সেই সাধ পূর্ণ বিষাদ সিন্ধুর স্রষ্টার। পাশাপাশি শায়িত আছেন অমরসঙ্গী হয়ে ।★

- Advertisement -
Latest news
Related news