অস্ত্রগুরু
হেমচন্দ্র কানুনগো বিনোদ মন্ডল
১৯৯৬। জুন মাসের মাঝামাঝি। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের তদানীন্তন অধ্যাপক ড: কোরক চৌধুরী এবং বিশিষ্ট লোক সংস্কৃতি গবেষক শ্রী চিন্ময় দাশের সংগে খাকুড়দার পার্শ্ববর্তী রাধানগর গ্রামে যাই। আগুনের পরশমণির ওম নিতে। মহাবিপ্লবীর জন্মভিটেতে। তাঁর জন্মের ১২৫ তম বর্ষে। তিনি অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র কানুনগো (১২জুন ১৮৭১ — ৮ এপ্রিল ১৯৫১)।
সেদিন তাঁর বংশের উত্তরপুরুষ শ্রী সমর কানুনগো আমাদের পরমাত্মীয়ের আন্তরিকতায় আতিথ্য দেন। সারাদিন সংগ দেন। ঘুরে দেখি চারপাশ। তাঁর মর্মর মূর্তিতে শ্রদ্ধা জানাই। সন্ধ্যায় ফিরে আসি। মনে হয়েছিল বড় একা এই মানুষটি ইতিহাসের কাছে সুবিচার পাননি। আজ তাঁর সার্ধশত তম জন্মজয়ন্তী বর্ষে সেই ধারণা এখনো অটুট রয়েছে।
হেমচন্দ্র মেদিনীপুর টাউন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। ভর্তি হন মেদিনীপুর কলেজে। কিন্তু এফ. এ. শেষ না করেই ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। যদিও অসমাপ্ত থেকে যায় তা। এরপর কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হন। পাশাপাশি চলে বউবাজার আর্ট গ্যালারিতে চিত্র প্রশিক্ষণ। সেই সুবাদে মেদিনীপুর কলিজিয়েট স্কুলে ড্রয়িং টিচার হিসেবে যুক্ত হন। একই সাথে মেদিনীপুর কলেজে রসায়ন বিষয়ের ডেমনস্ট্রেটরের কাজও চালিয়ে যান। তবে সেসময় বেতন অপ্রতুল হওয়ায় পরবর্তীকালে মেদিনীপুর জেলা বোর্ডে চাকরি গ্রহণ করেন। ভবিষ্যতে যেখানে তিনি ইন্ডিয়ান বোর্ডের প্রেসিডেন্টের আসন অলংকৃত করবেন।
বিশ শতকের সূচনায় জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর অনুপ্রেরণায় শিল্পী হেমচন্দ্রের জন্মান্তর হয়। এই সময় গুপ্ত সমিতির সংস্পর্শে আসেন তিনি। বরোদা থেকে বাংলায় ফিরে আসেন অরবিন্দ ঘোষ। ১৯০২ সালে যোগাযোগ হলো দুজনের। বিলেত ফেরত অরবিন্দের সংস্পর্শে দ্রুত ভাবনাচিন্তায় পরিবর্তন আসে হেমচন্দ্রের। দুজনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। অরবিন্দ ও তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর একটি তৈলচিত্র আঁকেন এইসময়। পূর্বেই মাতুলালয়ের আমবাগানে গোপন যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল। ‘সিক্রেট সোসাইটি’ র মাধ্যমে মেদিনীপুর শহরের ছাত্র যুব তরুণদের নিয়ে লাঠিখেলা, তলোয়ার চালানো, কুস্তি ও বক্সিং- এর প্রশিক্ষণ চলছিল। অরবিন্দের সৌজন্যে অনুশীলন সমিতি কলকাতা শাখার সংগে যোগাযোগ ঘটল মেদিনীপুর শাখার।
হেমচন্দ্র বিপ্লবের মঞ্চে পেশাদারিত্বের খোঁজে রাজনৈতিক ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণের তাগিদে এদেশের প্রথম বিপ্লবী যিনি বিদেশ যান। ১৯০৬ সালের ১৩ আগস্ট। বিলেত থেকে প্যারিসে। আক্ষরিক অর্থে যতটুকু যা সম্বল ছিল সব বিক্রি করে দিয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে যান। বোমা বানানোর ফরমুলা রপ্ত করেন। দেশে ফিরে আসেন ১৯০৮ এর জানুয়ারী মাসে। বানিয়ে ফেলেন তিনখানি বোমা। মুরারিপুকুরের বাগানে গোপন কারখানায়। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো তাঁর তৈরি তিনটি বোমার কোনোটাই লক্ষ্য ভেদ করতে পারে নি।
প্রথম বোমাটি ছোড়া হয় চন্দননগর এর মেয়রকে হত্যার লক্ষ্যে। অল্পের জন্য মেয়র সাহেব রক্ষা পান। দ্বিতীয়টি ছিল বই – বোমা। কলকাতায় চিফ প্রেসিডেন্সী মেজিস্ট্রেট অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার লক্ষ্যে এই বই-বোমা প্রেরিত হয়। তা ব্যর্থ হয়। তৃতীয় বোমাটি ১৯০৮ এর ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম প্রয়োগ করেন। তৎকালীন মজফ্ফরপুরের জেলা জজ কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে। তার পরিণতি ইতিহাসে বহু কথিত। ২ মে মুরারিপুকুর বাগানে সবাই ধরা পড়েন। অন্যদের প্রবল চাপেও স্বীকারোক্তি দেননি হেমচন্দ্র। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় (১৯০৯)। আলিপুর বোমা মামলায় দীর্ঘদিন জেল খেটে ১৯২১ এ মুক্তি পেয়ে বাংলায় ফিরে আসেন হেমচন্দ্র।
ইউরোপে থাকবার সময় বিপ্লব – জননী মাদাম ভিকাজি কামার সান্নিধ্যও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্ড শহরে বিশ্ব সোসালিস্ট কংগ্রেসের অধিবেশনে মাদাম কামার সাথে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর সহজাত শিল্পীসত্তার প্রতি আকৃষ্ট হন কামা। তিনি হেমচন্দ্রকে দেশের জাতীয় পতাকা অঙ্কনের অনুরোধ জানান। গেরুয়া, সবুজ ও লালের ব্যবহারে ত্রিবর্ণরঞ্জিত যে পতাকাটি হেমচন্দ্র অঙ্কন করেন,তাকেই স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকার সূচনালগ্ন ধরা হয়। প্রবাসী ভারতীয়দের এক সম্মেলনে সেই পতাকা উত্তোলন করা হয় সেবার। ঐতিহাসিক সে দিনটি ছিল – ২২ আগস্ট ১৯০৭।
মুক্তির পর বাংলায় যখন ফেরেন, তখন ইতিহাসে গান্ধী যুগের উত্তুঙ্গ হাওয়া। সেভাবে আর নিজেকে মেলে ধরেননি হেমচন্দ্র। নিজের রাধানগরস্থিত বসতবাটিতে আমৃত্যু কাটিয়ে দেন।
অবশ্য বামপন্থীদের সংগে শিথিল যোগাযোগ রয়ে যায় আন্দামান সূত্রে। বঙ্গীয় কৃষক সভার কার্যকরী সমিতির তালিকায় (১৯০২) সভাপতি হিসেবে দেখা যায় বঙ্কিম মুখার্জীর নাম। কার্যকরী সমিতিটে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুল গুপ্ত, আবদুল হালিম, সোমনাথ লাহিড়ী, সরোজ মুখার্জী সহ হেমচন্দ্রের নামও পরিলক্ষিত হয়। ১৯৪০ এ মানবেন্দ্রনাথ রায় রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানেও হেমচন্দ্রের নীরব উপস্থিতি লক্ষণীয়।
বাঁকুড়ার কবি পীতাম্বর ( কথিত ) রচিত কালজয়ী “একবার বিদায় দে মা” গানে ‘অভিরামের দীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি’ পংক্তিটি ব্যবহৃত হয়েছে । অনেকে মনে করেন যেহেতু উল্লাসকর দত্তের ছদ্মনাম ছিল অভিরাম, এখানে তাঁকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছেন লোককবি। কিন্তু আরো অনেকের মতো এই নিবন্ধকারের মত হলো এই `অভিরাম’ হলেন হেমচন্দ্র কানুনগো। ক্ষেত্রীয় সমীক্ষাকালে দেখেছি রাধানগরস্থিত তাঁর মর্মর মূর্তির তলায় নামের কাছে বন্ধনীতে ‘অভিরাম’ শব্দটি ব্যবহৃত। ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো, শিষ্যের পরিচয়ে তিনি আজ জগদ্বিখ্যাত। কেন না স্বাধীনতাপ্রেমী দেশবাসী জানেন, অগ্নিশিশু ক্ষুদিরামের প্রশিক্ষক ছিলেন অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র।