Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-১০৫।। দেবব্রত বিশ্বাস।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

প্রথা ভাঙনের কারিগর দেবব্রত বিশ্বাসবিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

টলিউডে শিল্পী সংসদের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার অনুরোধ নিয়ে তাঁর বাড়িতে হাজির মহানায়ক উত্তমকুমার। কিছুতেই তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। উত্তমকুমারও নাছোড়। শেষে শর্ত সাপেক্ষে মত দিলেন। কী সেই শর্ত ? অনুষ্ঠানের প্রচারে বা বিজ্ঞাপনে তাঁর নাম লেখা যাবে না। কথা রেখেছিলেন উত্তম। এমনকি মঞ্চে আহ্বানের সময়ও নাম উচ্চারণ করেননি। বরং মঞ্চে এসে মাইকে ঘোষণা করেন এবার গান শোনাবেন এক বিতর্কিত শিল্পী। মঞ্চে আসেন দেবব্রত (২২/০৮/১৯১১ — ১৮/০৮/১৯৮০)।

অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল জেলার ইটনা গ্রামে জন্ম তাঁর। ঠাকুরদা কালীমোহন ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার ফলে গ্রামে তাঁরা ধিক্কৃত হন, চলে যান কিশোরগঞ্জে। সেসব স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াত তাঁকে। শৈশবে ইটনার স্কুলে ‘ম্লেচ্ছ’ বলে উপহাস করত সহ পাঠিরা। ডাক নাম ছিল জর্জ। কথিত আছে রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লী দরবারে ভ্রমণের প্রাক্কালে তাঁর জন্ম। তাই এই নাম। পরে জর্জ বা জর্জদা নামেই বিখ্যাত হয়েছেন। অন্য একটি মতও চালু আছে। তার মা অবলা দেবী অসুস্থ থাকায় ছেলেকে গির্জায় সঁপে দিয়ে আসেন বাবা দেবেন্দ্রমোহন। তখন থেকে ফাদারের দেওয়া আদরের নাম জর্জ তাঁর ডাক নাম হিসেবে চালু হয়ে যায় ।

মায়ের কাছে শিখেছিলেন ব্রহ্মসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত। মহেন্দ্র রায়ের কাছে দেশের গান। কম্বুকণ্ঠের অধিকারী দেবব্রত বিশ্বাসের ভরাট গলায় যেকোনো গান শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করত। সম্মোহিত করত। এমনই সে সম্মোহন, গত শতকের চারের দশক থেকে যেকোনো ধরনের বাংলা গানের তিনি জাদুকর হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৩৩ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম. এ. পাশ করেন। চাকরি পান হিন্দুস্থান ইনসিওরেন্স কম্পানিতে। প্রথম বছর বিনা বেতনে কাজ করেন। পরের বছর চাকরি স্থায়ী হয়, বেতন পঞ্চাশ টাকা, মাসিক। এই চাকরি সূত্রে যোগাযোগ ঘটে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও তার ছেলে সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে। জোড়াসাঁকোয় যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। রবীন্দ্রসংগীতে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হন জর্জ।
ব্রাহ্ম হওয়ার সুবাদে সুরের রাজার সাথে প্রথম দেখা হয় ১৯২৮ সালে। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরে ভাদ্রোৎসব উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হন। তখন অসুস্থ ছিলেন। তা সত্ত্বেও গানের রাজা গান পরিবেশন করেন সভায়। রবি কণ্ঠের গানে সম্যক উপলব্ধি করেন শাস্ত্র বাক্য ‘ন বিদ্যা সংগীতাৎ পরা ‘। ৩০০ মতো রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করেছেন তিনি। বহু অপ্রচলিত রবীন্দ্র গান তাঁর কণ্ঠ মহিমায় জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু এই অতুলনীয় জনপ্রিয়তাই তাঁর শত্রু হয়ে উঠেছিল। গায়কীর নিজস্বতা বিশ্বভারতীর সংশ্লিষ্ট অধিকারীগণ মেনে নিতে পারেননি, তা নিয়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
শিল্পী কনক দাসের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯৩৮ সালে প্রথম সংকোচের বিহ্বলতা গানখানি রেকর্ড করেন জর্জ। পরের রেকর্ড ১৯৬১ সালে। হিন্দুস্থান রেকর্ড কম্পানি থেকে। ১৯৪৪ সালে ‘তাসের দেশ’ নৃত্যাভিনয়ে রাজপুত্রের গানগুলিতে তিনি কণ্ঠদান করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে বিশু পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। বহুরূপী পরিবেশিত তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ নাটকে মহিম চরিত্রে অভিনয় করেছেন জর্জ বিশ্বাস। কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর সুকণ্ঠের মর্যাদা দিয়েছেন। ‘মোর ভুলিবার সাধনায় কেন সাধো বাধ’ সহ দুটি গান তাঁকে দিয়ে তুলিয়ে রেকর্ড করান।

হিন্দুস্থান মিউজিক প্রোডাক্ট কম্পানি তাঁকে দিয়ে বাংলা ও ইংরেজি দ্বিভাষায় রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করায়। ইংরেজিতে গান গুলির অনুবাদ করেন শিবদাস ভট্টাচার্য। ১৯৬৪ সালে বিশ্ব ভারতী সংগীত সমিতির সাথে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। অভিমানে ক্ষোভে ১৯৭১ সালের পর আর কোনো রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করেননি জর্জ বিশ্বাস। এই নিয়ে তাঁর বিস্তৃত ভাষ্য পাওয়া যায় আত্মজীবনী ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’ গ্রন্থে। এপার বাংলা ওপার বাংলার বহু রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে নানা প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। একালের বিশিষ্ট নাট্যকার ব্রাত্য বসু ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’ শিরোনামে একটি নাটক রচনা করেছেন। যা ইতিমধ্যে মঞ্চসাফল্য লাভ করেছে। নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন দেবশংকর হালদার।

দেবব্রত বিশ্বাস বামপন্থায় আস্থা রেখেছেন আজীবন। যদিও কমিউনিস্ট পার্টির সব সিদ্ধান্ত সব সময় মেনে নিতে পারেননি। প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতেও ছাড়েননি। জাতীয় কংগ্রেসের নেপথ্য সম্মতিতে দেশ ভাগ হয়। কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের অবস্থানকে সমর্থন করে। জর্জ বিশ্বাস প্রতিবাদ করেন। একই ভাবে ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন শিল্পী মনে ক্ষতের সৃষ্টি করে। আই. পি. টি.এ.তে প্রথম থেকে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। কত গণসংগীতকে জনপ্রিয় করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রসংগীতকেও গণসংগীতের ওজস্বিতা দান করেছেন।

২৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভেনিউর বাসাবাড়িতে তখন শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের আড্ডা ছিল। বিষ্ণু দে ,শম্ভু মিত্র ,বিজন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ী ,হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, সুধী প্রধান, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ আসতেন। কলিম শরাফি আত্মগোপন করেছিলেন এই বাড়িতে। শাবানা আজমির বাবা কাইফি আজমিকে একবার ধুতি পৈতে পরিয়ে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এই আস্তানায়। অকৃতদার মানুষটির বাসায় গান শিখতে এসে বহু ছাত্রছাত্রী স্মরণীয় সময় যাপন করেছেন ।

ঋত্বিক ঘটকের ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। ‘মেঘেঢাকা তারা’য় ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গীতা ঘটকের সঙ্গে পরিবেশন করেছেন। ‘কোমলগান্ধার’ ছায়াছবিতে – ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। ভোলা যায়না ,’যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবিতে ঋত্বিকের লিপে জর্জ বিশ্বাসের কণ্ঠে ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’ গানটি।

দেশের বাইরেও নিজের কণ্ঠমহিমা প্রদর্শনের জন্য আমন্ত্রিত হন দেবব্রত বিশ্বাস। ১৯৫৩ সালে ভারতীয় শান্তি কমিটির উদ্যোগে চীন যাত্রা করেন। ১৯৫৮ সালে পুনর্বার ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চীন যান। তাঁর ‘অন্তরঙ্গ চীন’ গ্রন্থটিতে সেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত ধরা আছে। ব্রহ্মদেশে (বর্তমান মায়ানমার) বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের ডাকে সংগীত পরিবেশন করতে যান ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দেই। ১৯৮২তে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সংগীতানুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জন্মভূমিকে উদ্দীপ্ত করেন।

এদেশে একমাত্র দেবব্রত বিশ্বাসই রবীন্দ্র সংগীতকে আন্তর্জাতিক উচ্চতা প্রদানের লক্ষ্যে সংস্কৃত, ইংরেজি, জার্মানি, ফরাসি, রুশ প্রভৃতি ভাষায় সেকালে পরিবেশন করেছেন। ভাষাগুলি সুন্দর ভাবে রপ্ত করবার জন্যে তিনি দীর্ঘদিন ‘রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার’ (গোলপার্কে ) যাতায়াত করেছেন। নজরুলগীতি, গণসংগীত, আধুনিক গান, দেশাত্মবোধক গান নানা ক্ষেত্রে দিকপাল শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। স্বনামধন্য জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং সলিল চৌধুরীর সুরসংযোজন জর্জ বিশ্বাসকে সুখ্যাতি পেতে সহায়তা দান করেছে। একালেও ডিজিটাল – ভুবনে তাঁর জনপ্রিয়তা সমান গগনস্পর্শী ।★

- Advertisement -
Latest news
Related news