Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৮৮ ।। মেঘনাদ সাহা ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

সমাজবাদী বিজ্ঞানী
মেঘনাদ সাহা বিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

পিতৃদত্ত নাম ছিল মেঘনাথ। বিরক্ত ও বিব্রত হয়ে নিজেই নিজের নাম বদলে রাখেন- মেঘনাদ। জন্মেছিলেন ঝড় বৃষ্টির দিনে। তাই মেঘনাথ নাম দেওয়া হয়, ইন্দ্রদেবের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে। পৃথিবীর হিংসা ঈর্ষা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতাপে বিধ্বস্ত তিনি রাক্ষসের প্রতিনিধি হিসেবে ‘মেঘনাদ’ নামটিকে নির্বাচিত করেন। একবার পাড়ার ছেলেরা বারোয়ারি সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে এলে তিনি তাদের নিজের হাতে গড়ে তোলা বিশাল লাইব্রেরিতে নিয়ে যান। বাড়ির লাইব্রেরি দেখিয়ে তিনি বলেন-‘আমি এইভাবে সরস্বতীর আরাধনা করি। চাঁদা তুলে পুজোয় বিশ্বাস করিনা।’ বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি সামাজিক কুসংস্কার আর জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আপোষহীন এই লড়াইয়ের জন্য তিনি একাধারে বিজ্ঞানী ও সমাজবাদীও বটে

দলিত দরিদ্র পরিবারের সন্তান তিনি। মুদি দোকানি বাবার কষ্টের সংসার। বাবা চেয়েছিলেন টোলের পাঠ চুকিয়ে ছেলে বসবে তার দোকানে। বাদ সাধল তার বড়দা জয়নাথ চটকল শ্রমিক। ভাইকে ভর্তি করে দেয় সাত আট মাইল দূরে অবস্থিত শিমুলিয়া মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে। স্কুলের পাশে ডাক্তার অনন্ত দাসের বাড়ি। তাদের বাড়িতে গোয়াল ঘর দেখাশুনা করা এবং বাসন মাজার কাজ জোটে। বিনিময়ে থাকা খাওয়া ও স্কুল যাওয়ার সুযোগ মেলে। তাতেই সানন্দে রাজি হয়ে যায় মেধাবী কিশোর। ভবিষ্যতের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী,গণিত বিদ,জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা(০৬-১০-১৮৯৩—-১৬-০২-১৯৫৬)।
ঢাকা জেলার শেওড়াতলী গ্রামে জন্ম তাঁর।বাবার নাম জগন্নাথ সাহা। মা- ভুবনেশ্বরী দেবী। পরের বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকু পেয়েই পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষায় সবাই কে তাক লাগিয়ে দেন। ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম হন। সেখান থেকে এসে ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে (১৯০৫)। তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বাংলা উত্তাল। মেঘনাদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। গভর্নর বামফিল্ড ফুলার সাহেব বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসেন। মেঘনাদ ও তার সহপাঠীরা তাঁর ক্লাস বয়কট করেন। ফলে প্রতিবাদী ছাত্রদের বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় মেধাবৃত্তির টাকা।

পরের গন্তব্য কিশোরীলাল জুবিলি হাইস্কুল। এখানকার এক শিক্ষাব্রতী শিক্ষক বিনা বেতনে নিজের স্কুলে তার পড়াশুনার ব্যবস্থা করেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় চার টাকা বৃত্তিসহ উত্তীর্ণ হন তিনি। ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে বিজ্ঞান পড়েন। এখানে আই. এস. সির ফাঁকে ফাঁকে ডাক্তার নগেন্দ্রনাথ সেনের কাছে জার্মান ভাষা শিখে নেন।
এবার চলে এলেন কলকাতায়। গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। এরপর ১৯১৫ তে ফলিত গণিত নিয়ে স্নাতকোত্তর হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সহপাঠী ও সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। দুজনে মিলে আলবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার সূত্রকে জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। যা কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। বিকিরণ চাপ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ১৯১৮ সালে প্রাসঙ্গিক গবেষণাপত্রগুলিকে সংকলিত করে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রির জন্য অবেদন করেন। ১৯১৯ সালে এই ডিগ্রি তাঁর করায়ত্ত হয়। একই বছর প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করে ইংল্যান্ড এবং জার্মানীতে পাড়ি দেন গবেষণার বিষয় : – ‘অন হাভার্ড ক্ল্যাশিফিকেশন অফ স্টেলার স্পেকট্রাম।’
দরিদ্র দলিত পরিবারে জন্ম হওয়ায় আজীবন বর্ণবৈষম্যবাদের শিকার হয়েছেন তিনি। তবে হীনমন্নতায় হারিয়ে যাননি।ভেঙে পড়েননি। সমস্ত শক্তি সংহত করে গবেষণায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। স্কুলে পড়বার সময় সহপাঠীদের কাছে অপাংতেয় ছিলেন। প্রেসিডেন্সিতে এসে ও ব্রাহ্মণ্যবাদের কটাক্ষ শুনতে হয়েছে তাঁকে। কথিত আছে, সরস্বতী পূজায় পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পরে প্রেসিডেন্সি কলেজের ব্রাহ্মণ ছাত্ররা এক জোট হয়ে প্রকাশ্যে হেয় করেছেন- নিচু জাতের হয়ে ও কেন পুষ্পাঞ্জলি দেবে?

১৯১৯ সালে আমেরিকার আ্যস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে তাঁর ‘অন সিলেক্টিভ রেডিয়েশন প্রেসার এন্ড ইটস আ্যপ্লিকেশন’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্ব জুড়ে পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করেন। বিজ্ঞানের বিচিত্র ধারায় তাত্ত্বিক গবেষণার ধারায় বিষয়গুলি চমকে দেওয়ার মতো। তিনি ১। হাইড্রোজেনের গৌণ বর্ণালী ২। সূর্যের বায়ুমণ্ডলে বিকিরণ ঘটিত সাম্যাবস্থা ও নির্বাচন মূলক চাপ এবং সৌর ক্রোমোস্ফিয়ারে আয়নন প্রকাশ করেন। তিনি অঙ্ক কষে সূর্যের অন্তর্গত ক্যালসিয়াম,বেরিয়াম,হিলিয়াম, স্ট্রন্সিয়াম ও হাইড্রোজেন প্রভৃতি মৌলের আয়নন মাত্রা নির্ণয় করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও গবেষণার প্রয়োজনে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেছেন মেঘনাদ সাহা। তাঁরই উদ্যোগে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশ একাডেমি অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বায়োফিজিক্স গবেষণার সূত্রপাত করেন তিনি। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে নীরজনাথ দাশগুপ্ত তাঁর তত্ত্বাবধানে ভারতে প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরী করেন। ভূ-তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত আকর্ষণের ফলেই পরবর্তীকালে ভূ-তত্ত্ব বিদ্যা পাঠক্রম চালু করা সম্ভব হয়। পরে তিনি ভূ-তাত্ত্বিক সময় নিরূপণ বিষয়ে গবেষণা করেছেন।

তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো সদ্য স্বাধীন দেশ গঠনের লক্ষ্যে সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। প্রথম লোকসভার তিনি সদস্য হন। কলকাতা উত্তর পশ্চিম (তখনকার) কোদাল বেলচা প্রতীক নিয়ে( এখানে ও শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের চিহ্ন) বাম সমর্থিত নির্দল হিসেবে জয়লাভ করেন। তবে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য পদ লাভ করেননি। তিনি মহাত্মা গান্ধীর চরকা-খাদি-হ্যান্ডলুম নীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর মত ছিল ভারী শিল্প গঠনের দিকে। তিনি ১৯৫২ সালের ৩রা এপ্রিল থেকে আজীবন সংসদ সদস্য ছিলেন। লোক সভায় শিক্ষা, যোজনা,উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ,পরমাণুশক্তি ও রাজ্যগুলির পুনর্গঠন প্রসঙ্গে মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন।
প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর বিশেষ আগ্রহে ভারত সরকারের পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান হন তিনি। দেশের ৩০টি আঞ্চলিক পঞ্জিকাকে নিয়ে বিশ্লেষণ করে সব জাতি ধর্ম ভাবাবেগ মাথায় রেখে এই সংস্কার সাধিত হয়। যা বর্তমানে আমাদের দেশ ছাড়াও জাভা, বালি, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে চালু আছে। সারা পৃথিবীতে এই পঞ্জিকা প্রচলনের জন্য ১৯৫৪ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত U N O সম্মেলনে তিনি এটি উপস্থাপিত করেন। তবে ছোট্ট একটি ইহুদি গোষ্ঠির বিরোধিতায় তা বিশ্ব জুড়ে রূপায়িত হয়নি।

১৯৩৪ সালে তিনি তাঁর প্রবন্ধে প্রথম নদী উপত্যকা উন্নয়নের প্রস্তাব রাখেন। নদী কেন্দ্রিক শহর গুলির উন্নয়ন,বন্দর পরিকল্পনা, নদীর বাঁধ সংস্কার,নাব্যতা নিয়ন্ত্রণ, নদী সমূহের পারস্পরিক সংযোগ স্থাপন প্রভৃতি বিষয়ে আগ্রহ ছিল অসীম। তিনি ভর্তুকিপুষ্ট শাসন ব্যবস্থার চরম বিরোধী ছিলেন। তিনি তখন বলেছেন, এর ফলে কর্মনাশা জাতি ভিখারিতে পরিণত হবে। যা আজ ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। ‘নিচু জাত’ দতিল অন্ত্যজ প্রভৃতি শব্দবন্ধ ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন তিনি। ‘গণতান্ত্রিক শ্রেনি’ ব্যবহারে পক্ষপাতী ছিলেন। সমসাময়িক বরেণ্য তিন বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য্য উপাধিতে ভূষিত। জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র এবং সত্যেন্দ্রনাথ। কেন যে বাঙালি তাঁকে ‘আচার্য্য’ অভিধায় অভিহিত করেন না,এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত মানুষটির নাম ছয় ছয় বার বিজ্ঞানে নোবেলের জন্য আলোচিত হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নোবেল অধরা থেকে গেছে তাঁর। বলা হয়,তাত্ত্বিক প্রয়োগের দিকে আজীবন আলোকপাত করা মানুষটির সামগ্রিক কর্মকান্ডের মধ্যে যথেষ্ট ‘মৌলিক আবিষ্কার’ অনুপস্থিত। বাঙালির হৃদয়ে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, সন্দেহ নেই ।

- Advertisement -
Latest news
Related news