Saturday, July 27, 2024

ক্রান্তিকালের মনীষা-৯১ ।। গিরিশচন্দ্র ঘোষ।। বিনোদ মন্ডল

- Advertisement -spot_imgspot_img

বঙ্গের গ্যরিক
গিরিশচন্দ্র ঘোষবিনোদ মন্ডল

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

‘ আমি আর গুরুদেব যুগল ইয়ার
বিনির বাড়িতে যাই খাইতে বিয়ার’

বক্তা রসরাজ অমৃতলাল বসু। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি যে ‘গুরুদেবকে’ নিয়ে, তিনি, ওয়ান এন্ড অনলি’ গিরিশচন্দ্র ঘোষ (২৮.০২.১৮৪৪ — ০৮.০২. ১৯১২)। বলা বাহুল্য, উপরে উল্লিখিত ‘বিনি ‘ হলেন নাট্য সম্রাজ্ঞী বিনোদিনী দাসী। যিনি বিয়ার ফুরিয়ে গেলে আড্ডায় সরবরাহ করতেন বি-ফাইভ ব্র্যান্ডি।

বাবা- নীলরতন ঘোষ। মা-রাইমণি দেবী। অষ্টম সন্তান ছিলেন গিরিশ। অকালে মা বাবা এবং এক দাদার মৃত্যু হওয়ার ফলে কৈশোরে হাল ভাঙা নৌকোর মতো বেপথু হয়ে যান তিনি। হেয়ার স্কুল থেকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে লেখা পড়া। ফের স্কুল বদলে ভর্তি হন পাইকপাড়া স্কুলে। এখান থেকে এন্ট্রান্স ফেল (১৮৬২) করবার পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় দাঁড়ি পড়ে। তবে, বন্ধু ব্রজবিহারী সোমের প্রভাবে পড়াশুনা চালিয়ে যান, নিরলস। বিশেষত: ইংরেজি সাহিত্য এবং হিন্দু পুরাণ চর্চায় মেতে ওঠেন।

দুবার বিয়ে করেছেন। প্রথমা স্ত্রী প্রমোদিনী। দ্বিতীয়া সুরত কুমারী। পত্নী ও সন্তান সন্ততিদের মৃত্যু তাঁর জীবনকে দুর্যোগে ভরে দিয়েছে। সেই মর্মদাহ থেকে লিখেছেন — ‘জুড়াইতে চাই , কোথায় জুড়াই / কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই। / ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি / কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই।’

জন্মেছিলেন বাগবাজারে। জন্মভূমির নাম বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে অমর করে গেছেন। ঈশ্বর গুপ্তের প্রভায় প্রভাবিত হয়ে গান ও কবিতা লিখেছেন। হাফ আখড়াই-এর দলে ভিড়ে গিয়ে গান গেয়েছেন। অভিনয় করেছেন। প্রথমে বাগবাজার নাট্যদল, পরে তার থেকে গড়ে তুলেছেন বাংলার প্রথম পেশাদার নাট্যমঞ্চ ন্যাশনাল থিয়েটার (১৮৭২)।
সংসার চালাতে কতো ধরনের পেশায় যুক্ত থেকেছেন। শ্বশুরের চেষ্টায় এটকিনসন টিলকন কম্পানিতে প্রথম চাকরি পান। প্রথমে শিক্ষানবিশ। পরে দক্ষ বুককিপার। কখনো পার্কার কোম্পানিতে। বাকি সময় মঞ্চের ম্যানেজার হিসেবে। অথবা নাট্যদল সম্পর্কিত নানা কাজে। নিঃস্ব হয়েছেন।মামলা মোকদ্দমায় লাঞ্ছিত হয়েছেন। নিজের হাতে গড়া নাট্যদল তাঁর চোখের সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছে ‘নো এন্ট্রি’ নোটিশ।

কবি ,গীতিকার, নট, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক হিসেবে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন তিনি। শুধু নাটক নয় লিখেছেন তিনটি উপন্যাস। লীলা, ভক্ত ধ্রুব এবং চন্দ্রা। এছাড়াও একটি অসমাপ্ত উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি রেখে গেছেন — ‘ঝালোয়ার দুহিতা’ শিরোনামে। চন্দ্রা উপন্যাসটি সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচনা করেছেন। অন্যদিকে ‘ভক্ত ধ্রুব’ উপন্যাসটি পাঠ করে মুগ্ধ হন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ‘ভক্ত ধ্রুব’ অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক মধু বসু ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’ নামে একটি কাহিনীচিত্র নির্মাণ করে কবি ও নাট্যকারকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

স্বনামে ছাড়াও দু’ দুটো ছদ্মনামের ব্যবহার করেছেন গিরিশ। একটি মুকুটাচরণ মিত্র অন্যটি – সেবক। পাঠশালায় পড়বার সময় একটি হাফ আখড়াই এর আসরে ঈশ্বর গুপ্তকে সংবর্ধিত হতে দেখেন গিরিশ। সেই থেকে কবি হওয়ার বাসনা জাগে তাঁর। কালক্রমে লিখেছেন প্রায় আশিখানা নাটক। নানা রসের, নানা ভাবের, নানা ধারার, নানা ধরনের। পরিচালনা করেছেন অনেক বেশি নাটক। নাটকে অভিনয়ের উপযোগী শিল্পী গড়ে তুলতে বাংলায় তিনিই প্রথম পেশাদার অভিনয় শিক্ষাকেন্দ্র প্রস্তুতের তাগিদ অনুভব করেছেন। রূপায়িত করেছেন।

তাঁর ভাব শিষ্য ও শিষ্যাদের মধ্যে অন্যতম বিনোদিনী। যদিও নটী বিনোদিনীর প্রথম শিক্ষাগুরু এবং আবিষ্কর্তা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে বিনোদিনী নিজে আত্মজীবনীতে গিরিশচন্দ্রকে তাঁর প্রধান শিক্ষাগুরুর সম্মান প্রদান করেছেন। তবে প্রধানা শিষ্যার প্রতি উপযুক্ত মর্যাদা সব সময় দেওয়া সম্ভব হয়নি গিরিশের। সেই আক্ষেপ আজীবন তাঁকে পীড়া দিয়েছে। বিশেষত: ‘স্টার থিয়েটার’ নামকরণের পেছনের ঘটনাচক্রে বিনোদিনী যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছিলেন। গত শতকের আটের দশকে নট্ট কোম্পানি পরিবেশিত ” নটী বিনোদিনী” যাত্রাপালায় সেই অশ্রুসজল ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

১৮৮২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর স্টার থিয়েটারে ‘চৈতন্যলীলা’ নাটক দেখতে যান স্বয়ং রামকৃষ্ণ। সামগ্রিক দলগত অভিনয়ে মুগ্ধ হন তিনি। বিশেষত: নিমাই চরিত্রে তরুণী বিনোদিনীর ভাব- মগ্ন অভিনয়ে আপ্লুত হন তিনি। অভিনয়ের শেষে সাজঘরে গিয়ে বিনোদ ও তাঁর শিক্ষাগুরুকে আশীর্বাদ করেন — ‘তোদের চৈতন্য হোক ‘।
এই একটি রাত গিরিশচন্দ্রের জীবনে রূপান্তর ঘটায়। নাস্তিক, অনাচারী, ধর্মবিদ্বেষী গিরিশের নাম রামকৃষ্ণের শিষ্য তালিকায় অনিবার্যভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। যদিও এটা ছিল ঠাকুর ও গিরিশের তৃতীয় সাক্ষাৎ। ব্যক্তিজীবনে অশান্ত, ছন্নছাড়া, লম্পট গিরিশচন্দ্রকে বেহেড মাতাল অবস্থায় দেখলে তখন নিষিদ্ধপল্লীর সমাজকর্মীরা দুয়ারে আগল দিয়ে দিত। এমনই এক বিবিক্ত রাতে ঠাকুরের কাছে হাজির হন গিরিশ। পরম আদরে তাঁকে কাছে টেনে নেন রামকৃষ্ণ। ‘মদ খেয়েছিস তো কি, আমিও মদ খেয়েছি’। গিরিশের হাত ধরে মন্দির প্রাঙ্গণে নাচতে শুরু করেন তিনি। কণ্ঠে তখন -‘সুরাপান করিনা আমি, / সুধা খাই জয়কালী বলে, / মন-মাতালে মাতাল করে,/ মদ- মাতালে মাতাল বলে।’

গিরিশচন্দ্রের নাট্যসাধনার কালপর্যায় ধরে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় রামকৃষ্ণ তাঁকে কতখানি প্রভাবিত করেছেন। ছব্বিশ বছর বয়সে প্রথম ঠাকুরের সংস্পর্শে আসেন গিরিশ। ক্রমে রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ জীবন দর্শন সংক্রামিত হয়ে যায় তাঁর জীবন এবং সৃজনে। গিরিশচন্দ্রের বিল্বমঙ্গল ঠাকুর (১৮৮৮) ভক্তিমূলক জীবনী নাটক পাঠ করে তাঁর ফ্যান হয়ে যান নরেন্দ্রনাথ দত্ত। স্বামীজী বলেছেন – ‘আমি এরূপ উচ্চভাবের গ্রন্থ কখনো পড়িনি। এটি শেক্সপিয়রেরও উপরে গেছে ।’

শুধু একালে নয় তাঁর সময়েও বাংলা রঙ্গমঞ্চ নানা কারণে ঐক্যবদ্ধ নাট্যপরিচালনা এবং নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে অভিমুখ নির্ধারণে বিচঞ্চল ছিল। তাই তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও প্রতিভার সার্বিক মূল্যায়ণ সম্পন্ন হয়নি। তাঁর নাট্যশৈলী, প্রয়োগনৈপুণ্য, গীতিধর্মিতা, তাঁর সুবিশাল অভিনয় দক্ষতা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হওয়া দরকার। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলিকে নিয়ে যে নাট্য রূপান্তর ঘটিয়েছেন তার মূল্যায়ণ হয়নি। সেগুলো অনেকে গিরিশের নাট্য-পরিবারে স্থান দিতে নারাজ।

উনিশ শতকের নব জাগরণের প্রেক্ষাপটে তাঁর পৌরাণিক নাটক গুলিকে বিচার করতে হবে। ১৮৮২ তে মোট সাতখানি পৌরাণিক নাটক লিখেছেন তিনি। তা কি শুধু রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজনে ? নাকি এর মধ্য দিয়ে নতুন কোনো বার্তা দিতে চেয়েছেন সমাজ ও স্বজনকে। এই বছরেই সীতার বনবাস (১৮৮২) নাটক উৎসর্গ করেছেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে।

সময়ের নানা সংকট, সামাজিক সমস্যা উঠে এসেছে তাঁর সামাজিক নাটকগুলিতে। ‘প্রফুল্ল’ নাটকে “আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে ” আর্তনাদ আজও পাঠকের মনে একান্নবর্তী সংসারের ভাঙনকে মূর্ত করে তোলে। আবার ঐতিহাসিক নাটকগুলি পরাধীন স্বদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, তাঁর সন্তান দানীবাবুর কথা। পোশাকি নাম সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ। অসাধারণ ঢোলক বাজাতেন। পরে পাকাপাকি ভাবে নাটকে অভিনয়ে চলে আসেন। বঙ্গভঙ্গের সময় ‘সিরাজদ্দৌল্লা’ নাটকে সিরাজের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। সমকালের অন্যতম বলিষ্ঠ এই অভিনেতা বহু নাটকে বাবার সংগে মঞ্চ দাপিয়ে অভিনয় করেছেন।

বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে গিরিশচন্দ্রের নানা কীর্তি তাঁকে কিংবদন্তি করে তুলেছিল। ‘সধবার একাদশী’ নাটকে (১৮৬৯) নিমচাঁদের ভূমিকায় অভিনয় করে প্রথম দর্শক বন্দিত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নাটকটির চতুর্থতম রজনীর অভিনয় চাক্ষুষ করেন স্বয়ং নাট্যকার। অভিনয় শেষে অভিভূত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে নন্দিত করেন। ১৮৭৭ সালে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’কে মঞ্চায়িত করেন গিরিশ। একাই রাম ও মেঘনাদের ভূমিকায় দাপটের সাথে অভিনয় করেন। যা দেখে বঙ্কিম শিষ্য অক্ষয়চন্দ্র সরকার (প্রাবন্ধিক ও ‘সাধারণী ‘ পত্রিকা সম্পাদক) তাঁকে ‘বঙ্গের গ্যারিক’ অভিধায় ভূষিত করেন।
স্টার , এমারেন্ড, মিনার্ভা, ক্লাসিক, কোহিনূর প্রভৃতি রঙ্গালয়ের সাথে যুক্ত মানুষটি জীবনের শেষ মঞ্চাভিনয় করেছেন ১৯১১ সালের ১৫ জুলাই। শনিবার, মিনার্ভা থিয়েটারে। বৃষ্টির সেই রাতে খালি গায়ে বলিদান নাটকে করুণাময়ের ভূমিকায় অভিনয় করে অসুস্থ হন। শীতকালে হাঁপানি ছিল নিত্য সংগী। ধীরে ধীরে শয্যাশায়ী হয়ে যান বাংলা নাটকের মুকুটহীন সম্রাট ।

- Advertisement -
Latest news
Related news