Saturday, July 27, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-১৬০।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল                                                                  চিন্ময় দাশ                             বিষ্ণু মন্দির, জিনশহর               (খড়গপুর গ্রামীন, পশ্চিম মেদিনীপুর)
মেদিনীপুর জেলা শহর ছুঁয়ে বয়ে চলেছে চিরপ্রবাহিনী কংসাবতী। কতকালের প্রাচীন এই স্রোতস্বিনী। পূর্বকালে যার নাম ছিল—কপিসা।
শহর ছাড়িয়ে এই নদীর পূর্বমুখী নিম্নস্রোতে, সামান্য দূরেই, দুই তীরে দুটি বিখ্যাত জনপদ। উত্তরে মন্দিরময় গ্রাম পাথরা। মাননীয় ইয়াসিন পাঠান মহাশয়ের সুবাদে, অধুনা বিশ্বময় যার খ্যাতি। আর, দক্ষিণের জনপদটিতে, সুদুর অতীতে একটি জৈন ধর্মকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। তাকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছিল যে জনপদ, আজও তার নাম—জিনশহর। বিশালাকার এক পাথরের মন্দিরের খণ্ডহর আজও আছে সেই গ্রামে। পাষাণস্তুপের কন্দরে ঘুমিয়ে আছে দেড়-দু’হাজার বছরের মৌন ইতিহাস।আমাদের আজকের জার্ণাল জিনশহর গ্রামকে কেন্দ্র করেই। তবে, সেই পাষাণসৌধকে নিয়ে নয়। (পরে কোন এক সংখ্যায় থাকবে জৈন স্থাপত্যটি। প্রস্তুতি পর্ব চলছে সেই কাজের।) সেখানেই, জৈন মন্দিরের অদূরেই, পড়ে আছে একটি হিন্দু দেবালয়। বিগ্রহ নাই গর্ভগৃহে। ধূপ-দীপ জলে না বহুকাল। বাতাস মুখরিত হয় না কাঁসর-ঘন্টার শব্দে। থেমে আছে সব কিছু। বয়ে চলে কেবল চির বহমান কংসাবতী। জৈন মন্দিরের দুঃখগাথার সাথে, ভগবান বিষ্ণুর হিন্দুমন্দিরটির হাহাকারও ভেসে যায় এ নদীর বুক বেয়ে।
হা-হুতাশ রেখে, আমরা বরং ইতিহাসের পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারি। কেন না, ইতিহাস নির্মম। কিন্তু ইতিহাসই অক্ষয়। কিছুই মুছে ফেলা যায় না তার পাতা থেকে। আমরা এখন চোখ বুলিয়ে নেব সেসকল পাতার দুটি-একটি অনুচ্ছেদে।
বাংলায় স্থলপথের উন্নতির আগে, জলপথই ছিল পরিবহনের মুখ্য উপায়। একসময় দূর-দূরান্তরে যাতায়াত ছাড়াও, কংসাবতী নদীপথে, বাণিজ্যিক পরিবহনের কাজও সম্পাদিত হোত। তারই সুবাদে, বহু জনপদ, গঞ্জ, নগর গড়ে উঠেছিল এ নদীর দুই তীরে। বিভিন্ন উপায়ে অর্থসমৃদ্ধও হয়ে উঠেছিল বহু পরিবার।
জিনশহর গ্রামের সুকুল পদবীর একটি ব্রাহ্মণবংশও সেভাবেই ধনী হয়ে উঠেছিল। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের অনুসারী হয়েছিলেন সুকুলরা। ভগবান বিষ্ণুকে কুলদেবতা হিসাবে বরণ করেছিলেন। একটি শালগ্রাম (বিষ্ণুশিলা) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কুলদেবতা হিসাবে। নিজেরা ব্রাহ্মণ ছিলেন। কিন্তু ধনাঢ্য এই বংশ পৃথক পুরোহিত নিয়োগ করেছিল মন্দিরে।
ইং ১৭৬০ সালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি মেদিনীপুর জেলার শাসনাধিকার পায় ততকালীন নবাব মীর কাসিম-এর দেওয়া সনন্দমূলে। পরে পরে ইংরেজের মাণদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হতে সময় লাগেনি। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে, ১৭৯৩ সালে ভারতের বড়লাট ছিলেন লর্ড কর্ণও্যালিশ, তিনি ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপ্রথা’ চালু করেন। সেই আইনের অভিঘাতে, নতুন নতুন জমিদারের উদয় হয়েছিল সারা বাংলাইয়, মেদিনীপুর জেলাতেও।
তখন এর সাথেই, ইংরেজের হাতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চাকরি-বাকরি— সামাজিক অর্থনৈতিক সব দিকেই মেদিনীপুর নগরী বিকশিত হতে শুরু করেছিল। পরে তো, এই শহরকে জেলার ‘সদর’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
এ সময়েই শুরু হয় রাজা, জমিদার আর ধনাঢ্য পরিবারদের মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা হওয়ার হিড়িক। জেলার দূরবর্তী এলাকার বহু পরিবারই মেদিনীপুর শহরে এসে, স্থায়ী অধিবাসী হয়ে উঠেছিলেন। স্থায়ীভাবে উঠে আসবার উপায় ছিল না যাঁদের, তাঁরা নিদেন একটা প্রাসাদ বা অট্টালিকা গড়ে নিয়েছিলেন জেলা শহরে।
এই কালপর্বে, সুকুলবংশও কংসাবতী পার হয়ে, চিরকালের জন্য মেদিনীপুর শহরে চলে এসেছিলেন। আজও তাঁরা এই শহরের অধিবাসী হয়ে আছেন। শহরের বড়বাজারে বিখ্যাত শীতলা মন্দিরটি, সুকুলবংশের জয়গাথা ঘোষণা করছে আজও।
সুকুলর্‌ বাস্তু ত্যাগ করার সময়, ফেলে এসেছিলেন দেবালয়টিকে। কুলদেবতার বিগ্রহটি ফেলে আসেননি। বুকে করে এনেছিলেন শহরের নতুন বাসভূমিতে। সেখানেই তিনি অধিষ্ঠিত থেকে পূজিত হচ্ছেন।
দালান-রীতির পূর্বমুখী বিষ্ণুমন্দিরটি তখন থেকে বিগ্রহহীন, পরিত্যক্ত। ইট এবং পাথর দুই উপাদানেই গড়া হয়েছিল এই মন্দির। অলিন্দের স্তম্ভগুলি পাথরের, গর্ভগৃহ সহ বাকি অংশ ইটের উপাদানে গড়া।
মন্দিরের ভূমি-নকশা আয়তাকার– দৈর্ঘ্য ১৮ ফুট, প্রস্থ ১৫ ফুট, উচ্চতা ১২ ফুট। অলিন্দের সিলিং টানা-খিলানের। গর্ভগৃহের ছাদ সম্পূর্ণই বিলুপ্ত, বিবরণ দেওয়ার কোন অবকাশ আজ আর নাই।
টেরাকোটা আর পঙ্খের কাজ করা হয়েছিল মন্দিরের অলঙ্করণ হিসাবে। তবে, টেরাকোটার কাজগুলি ভারি মোটা হাতের। স্তম্ভগুলির মাথায় তিনটি খিলানে লাল রঙের পঙ্খের কাজ ছিল। জ্যামিতিক এবং ফুলকারী নকশা ছাড়াও, খিলানগুলির কেন্দ্রীয় স্থানে একজোড়া করে পারাবত রচিত।
স্তম্ভগুলির মাথা বরাবর, খাড়াভাবে দুটি প্যানেল। তাতে তিনটি করে খোপ। সেগুলিতে ভীষণভাবে ক্ষয়িত কয়েকটি মূর্তি এখনও আছে। কিন্তু পরিচয় উদ্ধারের কোন উপায় নাই।
টেরাকোটা ফলকের বিন্যাস করা হয়েছিল সামনের দেওয়ালেও– কার্ণিশের নীচে, তিনটি প্রস্থে। বামে ত্রিভঙ্গ ভঙ্গীমায় বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানি। মাঝখানে নন্দীবাহন মহাদেব শিব। ডাইনে রামচন্দ্র ও সীতা দেবী।
ফলক রচিত হয়েছিল গর্ভগৃহের সামনের দেওয়ালেও। দ্বারপথের দু’দিকে দুটি দ্বারপালক। এছাড়া, চারটি পৃথক প্যানেলে কার্তিক, গ্ণেশ, লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর মূর্তি। তবে, অলঙ্করণগুলির ভারি জীর্ণ দশা।
সমগ্র মন্দিরের বহিরঙ্গ ও অভ্যন্তর ভাগ মসৃণ পঙ্খের প্রলেপে মোড়া ছিল, তার নমুনা দেখা যায়।
দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত হওয়ার কারণে, বর্তমানে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরসৌধটি। প্রকৃতপক্ষে, সম্পূর্ণ ধ্বংসেরই প্রতীক্ষায় পলে পলে দিন গুণছে দেবালয়টি– আমাদের সকলের চোখের সামনেই!
সাক্ষাৎকারঃ শ্রীমতি সুষমা রায়। শ্রী দেবাশীষ রায়—জিন শহর।
পথ-নির্দেশঃ  মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে হলদিয়া গামী রাস্তায়, মুম্বাই রোড-এর আগেই, জিনশহর স্টপেজ। উত্তরমুখে কিমিখানিক দূরেই মন্দির, কংসাবতীর কূলে। বীরেন্দ্র সেতু পার হয়ে, নদীর বাঁধ ধরেও মন্দিরে পৌঁছানো যায়।
বিখ্যাত জৈন মন্দিরটিও অদূরেই অবস্থিত। সেটিও দেখে নেওয়া যায় এক সাথে।
মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দাদের কাছে, ঘর থেকে শুধু দু’পা ফেলেই মন্দির।

- Advertisement -
Latest news
Related news