Saturday, July 27, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল-১২১।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
                                        চিন্ময় দাশ

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

গোপীনাথ মন্দির, বেলিয়াবেড়া (বেলিয়াবেড়া)

ইতিহাস আর লোকশ্রুতি—দুই উপাদানে বোনা এই মন্দিরের আখ্যান। প্রথমে ইতিহাসের দুয়েকটি কথা বলি আমরা ।
সময়কাল একাদশ শতাব্দীর শেষ পাদ। ওডিশায় কেশরীবংশকে উৎখাত করে, অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গদেব গঙ্গবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দীর্ঘ চারশ’ বছর শাসনের পর, ক্ষমতায় আসে সূর্যবংশীয়রা। স্বল্পায়ু এইবংশের শেষ রাজা ছিলেন প্রতাপ রুদ্রদেব।

দীক্ষা গ্রহণ করে, মহাপ্রভু চৈতন্যদেব প্রথম পুরীতে আসেন। জীবনের শেষ দুই যুগের সিংহভাগ জগন্নাথধাম পুরীতেই কাটিয়েছেন। সেসময় ওডিশার মহারাজা এই প্রতাপ রুদ্রদেবের শাসনকাল। তাঁরা উভয়েই পরস্পরের সান্নিধ্য এবং সখ্যতা লাভ করেছিলেন। চৈতন্যদেবকে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ অবতার হিসাবে বিবেচনা করতেন প্রতাপ রুদ্রদেব। তাঁর চাহিদাতেই, বিখ্যাত ‘চৈতন্য-চন্দ্রোদয়’ নাটক রচনা করেছিলেন কবি কর্ণপুর।
যাইহোক, বখতিয়ার খিলজীর নবদ্বীপ বিজয়ের পর থেকে, মুসলমান শাসকগণ বারংবার ওডিশা অধিকারের জন্য আক্রমণ সংঘটিত করেছেন। সূর্যবংশের শাসনকালে, পাঠান শাসক সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহও আক্রমণ করেছেন ওডিশায়। নবাবের দুরাচারী ও নৃশংস সেনাপতি ইসমাইল গাজীর পুরী নগরী এবং বহু দেবালয় ধ্বংসের কথা ‘মাদলাপঞ্জী’তেও উল্লেখ করা আছে।

সেই দুর্যোগের কালে, জনৈক নিমাই চাঁদ ছিলেন পুরীরাজের দরবারে একজন পদস্থ কর্মচারী। প্রাণ এবং স্বধর্ম রক্ষার তাগিদে তিনি পুরী ছেড়ে প্রতিবেশী জঙ্গলখণ্ড এলাকায় পালিয়ে এসেছিলেন।
জঙ্গলখণ্ডে পৌঁছে, একেবারে নাটকীয় উত্থান ঘটেছিল নিমাই চাঁদের। বহু গল্প, লোকশ্রুতি ছড়িয়ে আছে তাঁর জীবনকথা নিয়ে। আমরা দুটি মুখ্য লোকশ্রুতি শোনাব এখানে।
লোকশ্রুতি ১ ঃ জঙ্গলখণ্ডে পৌঁছে, ঘুরতে ঘুরতে একদিন ঝাড়গ্রামে হাজির হয়েছেন নিমাই চাঁদ। দূপুরের রান্নার কাজ করছেন রাজবাড়ির মূল ফটকের বাইরে। ঝাড়গ্রামের সিংহাসনে তখন রাজা সংসার মল্ল। সুস্বাদু রান্নার মিষ্টি সুবাস বাতাসে ভাসতে ভাসতে দরবারে এসে ঢুকল। ভুরু কোঁচকাল সকলের। রাজার হুকুম পেয়ে, পেয়াদা প্রাচীরের বাইরে থেকে, দরবারে এনে হাজির করেছিল নিমাই চাঁদকে। কিন্তু রাজার কাছে পূর্বের পরিচয় একটুও ভাঙেননি হুঁশিয়ার নিমাই চাঁদ। রাজা তাঁকে পাচকদের মাথায় বসিয়ে, পাকশালে নিয়োগ করে দিয়েছিলেন।

লোকশ্রুতি ২ ঃ একবার পারিষদবর্গ নিয়ে মহাল পরিক্রমায় বেরিয়েছেন রাজা। শিবির পড়েছে পাহাড়ি নদী ডুলুংয়ের চরে। রাজা দুপুরের আহারে বসেছেন। রোদ আড়াল করতে, নিজের ছাতাটি খুলে, রাজার মাথায় ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন নিমাই চাঁদ।
আহারের পর পুলকিত রাজা বললেন—এবার ছাতাটি রেখে, নিজে আহারে বসো।
মাটিতে চোখ নামিয়ে নিমাই বললেন—নিজের ছাতা নামিয়ে রাখতে পারি, ততটুকু ভূমিও তো নাই আমার। সব ভূমি তো আপনার।

রাজা বুঝে গেলেন, কেবল রান্নার হাত নয়, ক্ষুরধার একটি মস্তিষ্কও আছে বিচক্ষণ মানুষটির। নীরবে পাকশালায় কাজ করেছে। কোনদিন মুখ ফুটে বলেনি কিছু। আজ রাজার কাছে কিছু প্রত্যাশা করছে।
নিজের ঘোড়ার লাগাম ধরিয়ে দিয়ে, রাজা নিমাই চাঁদকে বললেন—ঘোড়া হাঁকাও। এক প্রহরের ভিতর যতটা ঘুরে আসবে, তার সব ভূমি তোমার। কেবল ছাতাটুকুই নয়, বংশপরম্পরায় তুমিও থাকতে পারবে সেই ভূমিতে।
পাথরা গ্রাম থেকে পূর্বমুখী হয়ে ছুটল ঘোড়া। কালিঞ্জা গ্রামে দক্ষিণে মুখ ঘোরালেন। ঝাটিয়াড় থেকে পশ্চিমে আশুই। তারপর উত্তরমুখী হয়ে পাথরায় ফিরে এলেন নিমাই চাঁদ। এক প্রহরের মধ্যেই।

এক প্রহরে একশ’খানা গ্রাম পরিক্রমা করেছেন। রাজা সংগ্রাম মল্ল ‘প্রহরাজ’ খেতাব দিলেন নিমাই চাঁদকে। সেই সাথে একশ’টি গ্রামের জমিদারী। পুরীরাজের দরবার ছেড়ে এসে, পাচক নিয়ুক্ত হয়েছিলেন। এবার নিজেই একজন জমিদার হয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেন প্রহরাজ নিমাই চাঁদ।
যে ভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজের সম্পত্তি পেলেন, সেখানেই থিতু হয়েছিলেন নিমাই চাঁদ। পাহাড়ি নদী ডুলুং। তার বালিময় প্রান্তরে রাজধানি স্থাপন করেছিলেন। নানান জাতি নানান বৃত্তির মানুষজন এনে বসত করিয়েছিলেন। নতুন জনপদ গড়ে উঠেছিল বন্ধ্যা প্রান্তরের বুকে। গ্রামের নাম হয়েছিল বালিয়াবেড়া। কালে কালে সেই নাম বেলিয়াবেড়া হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে।

শহর-গঞ্জ থেকে অনেকখানি দূরে, প্রায় নির্জন নদীতীরে অট্টালিকা গড়েছিলেন। সেকারণে, পাথরের উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হয়েছিল রাজবাড়িকে। মূল ফটকটি আজও নিমাই চাঁদের শৌর্য আর গরিমার চিহ্ন হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে।
এদিকে, পুরীরাজ প্রতাপরুদ্রই কেবল চৈতন্যদেবের সান্নিধ্য আর সংস্পর্শে আসেননি। তাঁর পারিষদগণও সেই পরশমণির ছোঁয়া পেয়েছিলেন। নিমাই চাঁদ নিজেও সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনিও।

জমিদার হিসাবে থিতু হয়ে, কৃষ্ণ আরাধনার সূচনা করেছিলেন পরিবারে। শ্রীকৃষ্ণকে কুলদেবতা হিসাবে বরণ করেছিলেন। প্রাসাদের গায়েই মন্দির গড়ে গোপীনাথ নামে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন।

উঁচু পাদপীঠের উপর পাথরে তৈরি পূর্বমুখী মন্দির। সামনে একটি পঞ্চ-দ্বারী অলিন্দ। পিছনে এক-দ্বারী গর্ভগৃহে একেবারে রাজকীয় একটি সিংহাসনে দেবতাদের অধিষ্ঠান। তবে, মন্দির সৌধটিতে কোণও অলঙ্করণ নাই।
রাজবাড়ির প্রাচীরের একেবারে সামনে সমতল ছাউনির একটি রাসমঞ্চ আছে গোপীনাথের। সেটির গড়নও একেবারে রাজসিক।

সাক্ষাৎকার ঃ সর্বশ্রী প্রহরাজ সুরজিৎ দাস মহাপাত্র, বিশ্বজিৎ দাস মহাপাত্র, শ্যামাপদ হোতা– বেলিয়াবেড়া।
পথ-নির্দেশ ঃ মুম্বাই রোডের লোধাশুলি থেকে মহাপাল হয়ে, কিংবা ফেকোঘাট থেকে তপশিয়া হয়ে বেলিয়াবেড়া।

- Advertisement -
Latest news
Related news