Saturday, July 27, 2024

Temple Tell: জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল- ১৬৪।। চিন্ময় দাশ

- Advertisement -spot_imgspot_img

জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল
শীতলা মন্দির, সুরতপুর                                             (দাসপুর,পশ্চিম মেদিনীপুর)চিন্ময় দাশ

আরো খবর আপডেট মোবাইলে পেতে ক্লিক করুন এখানে

গুড়লি আর সুরতপুর। একেবারে গায়ে গা লাগানো দুটি মৌজা, বা গ্রামও। কিন্তু আলাদাভাবে নয়, লোকজন গুড়লি-সুরতপুর নামেই উচ্চারণ করেন তাদের।
কারণও আছে তার। শিলাবতী নদীর কোলে অবস্থান গ্রাম দুটির। এক সময় বিদেশী বণিকদের হাতে রেশম শিল্পের প্রভূত বিকাশ হয়েছিল এখানে। এখনও উঁচু চিমনি সহ, তিন-চারটি জীর্ণ রেশম কুঠি, শিলাবতীর কূলে সাহেবঘাটা স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে টিকে আছে।
রেশম শিল্পের সুবাদে, কেবল ফরাসি, ওলন্দাজ, আর্মেনিয়ান বা ইংরেজ বণিকেরা ধনবান হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। স্থানীয় কিছু ব্যক্তিও প্রভূত ধনসম্পদের মালিক হয়ে উঠেছিলেন। শিব, শীতলা, বিষ্ণু প্রভৃতি অনেকগুলি মন্দিরও গড়ে উঠেছিল তাঁদের হাতে।
সুরতপুর গ্রামের হাজরা পরিবার ছিল সেই ধনীদের অন্যতম। লোকদেবী শীতলার একটি মন্দির গড়েছিল হাজরা বংশ। মন্দিরের প্রতষ্ঠা ফলক থেকে জানা যায়, জনৈক শত্রুঘ্ন হাজরা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তার পর প্রায় পৌনে দু’শ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। সাত-আট পুরুষ কেটে গিয়েছে হাজরা বংশের। অনেকগুলি পরিবারে ভাগও হয়ে গিয়েছে বংশটি। দু’-তিনটি দৌহিত্র বংশও শরিকানা পেয়ে, মন্দিরের সেবাপূজায় যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে দেখা যায়, মূল হাজরা বংশ, তিনটি দৌহিত্র বংশ এবং ধর্মপ্রাণ গ্রামবাসীগণের পরিচর্যায় আছে মন্দিরটি।
নিত্যপূজা ছাড়াও, আশ্বিনে বিশেষ আড়ম্বরের সাথে ৫ দিনের দুর্গাপূজা, অঘ্রাণে নবান্ন, পৌষে মকর, দোল-চাঁচর, ফাল্গুনে দেশপূজা—ঘটা করে আয়োজিত হয় এখানে। মন্দিরটিও ভারি সুদর্শন।
দুটি প্রতিষ্ঠা ফলক আছে মন্দিরে। পূর্ব এবং দক্ষিণের দেওয়ালে। সেগুলি থেকেই জানা যায়, ইং ১৮৪৯ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।
সেকালে গঙ্গার পশ্চিমে শ্রেষ্ঠ মন্দির স্থপতি ছিলেন ঠাকুরদাস শীল। তখনকার রাজা জমিদাররা, তাঁকে দিয়ে মন্দির গড়বার জন্য, নাম লিখিয়ে রাখতেন। ঠাকুরদাসের হাতেই গড়ে উঠেছিল হাজরা বংশের শীতলার এই মন্দিরটি।
মন্দিরে দেখা যায়, সামনে ইমারতি-রীতির থাম আর দরুণ-রীতির খিলানের তিন দুয়ারী অলিন্দ। পিছনে এক দুয়ারী গর্ভগৃহ। এই নিয়ে ইটের তৈরি পূর্বমুখী মন্দির। রত্ন-রীতির পঞ্চ-রত্ন হিসাবে নির্মিত হয়েছে।
মন্দিরের মাথায় চালা-রীতির ছাউনি দেওয়া। চালার জোড়মুখগুলি ‘বিষ্ণুপুরী রীতি’র। কার্ণিশের বঙ্কিম ভাবটি ভারি মনোরম। সুন্দরী রমণীর আয়ত আঁখিপল্লবের মত।
রত্নগুলির বাঢ় ও গণ্ডী অংশে কলিঙ্গশৈলীতে রথ-বিভাজন এবং গণ্ডী অংশে পীঢ় ভাগ করা। চুড়া বা শীর্ষক অংশে ক্রমান্বয়ে বেঁকি, আমলক, কয়েকটি কলস এবং বিষ্ণুচক্র রচিত আছে।
একটি প্রশস্ত নাটমন্দির আছে মন্দিরের সামনে।
এই মন্দিরের গৌরব পঙ্খের কারুকাজ আর টেরাকোটা ফলক সমাবেশের জন্য। কেবল মন্দিরের কারিগরী কৌশল নয়, ঠাকুরদাস শীলের কৃতিত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব, ইট পাথরের একটি সৌধকে অলঙ্করণে মণ্ডিত করে, রূপবতী করে গড়ে তোলা। ডেবরা থানার বলরামপুর গ্রামের সীতারাম মন্দির, খড়গপুর থানার চমকা গ্রামের শ্রীধর মন্দির ইত্যাদি ঠাকুরদাসের সৃষ্টি। আজও শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দখল করে রেখেছে মন্দিরগুলি।
সুরতপুর গ্রামের এই শীতলা মন্দিরে পঙ্খের কাজে জ্যামিতিক আর ফুলকারী নকশা দেখা যায়। ঠাকুরদাস তাতে লাল রঙের প্রয়োগ করেছিলেন। এর সাথে নিপুন হাতে সৃষ্টি করেছিলেন অজস্র টেরাকোটা ফলক।
টেরাকোটা ফলকগুলির মোটিফ ভাগ করে দেখা যেতে পারে। রামায়ণ থেকে—সীতাহরণ, জটায়ুর যুদ্ধ, রাম-রাবণের লঙ্কা যুদ্ধ।
পুরাণ থেকে—বিষ্ণুর অনন্ত নাগ শয্যা, দশাবতার ইত্যাদি।
কৃষ্ণলীলা থেকে—বেশি সংখ্যক ফলক কৃষ্ণকথা ভিত্তিক। পুতনা বধ, বকাসুর বধ, কালীয় নাগ দমন, কৃষ্ণের গোবর্ধন গিরি ধারণ, কৃষ্ণ-বলরামের গোষ্ঠবিহার, নৌকাবিলাস, গোপিনীদের বস্ত্রহরণ, শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার দ্বারকা গমণ ইত্যাদি।
ভারি বিশিষ্ট একটি ফলক আছে এই মন্দিরে। শ্রীকৃষ্ণের তাল ও খেজুরগাছে আরোহন রুপায়িত হয়েছে ফলকটিতে। বেশ বিরল দৃষ্টান্ত এটি।
চণ্ডীমঙ্গল থেকে—অনেকগুলি ফলক আছে চণ্ডীমঙ্গল থেকে। ধনপতি সওদাগরের কমলে কামিনী দর্শন, সিংহলের রাজা কর্তৃক ধনপতিকে বন্দী করা, শ্রীপতিকে উতপীড়ন, শ্রীপতি ও সুশীলার বিবাহ ইত্যাদি।
দু’-একটি মিথুনদৃশ্যও আছে মন্দিরে। আর আছে ভিনিশীয় দরজার প্রান্তে প্রিয়জনের জন্য প্রতিক্ষারত নারী। যার নাম– দ্বারবর্তিনী মূর্তি। সেটি স্টাকোর কাজ। টেরাকোটার দুটি দ্বারপাল মূর্তিও আছে গর্ভগৃহের দ্বারপথের দু’পাশে।
সুখের কথা, মন্দিরটি ভারি সযত্ন রক্ষিত। সেবাইত বংশ এবং গ্রামবাসীগণের সদাসতর্ক দৃষ্টি মন্দিরে জীর্ণতার আঁচটিও লাগতে দেয় না, সেটি বেশ অনুভব করা যায়।
সাক্ষাতকারঃ সর্বশ্রী সুবল মণ্ডল, জয়দেব হাজরা, অসিত বরণ মাইতি, বিশ্বনাথ হাজারী, বিপ্লব হাজারী—সুরতপুর।
পথনির্দেশঃ দ. পূ. রেলপথের পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে ঘাটালগামী রাস্তায় বকুলতলা। সেখান থেকে নাড়াজোল মুখী রাস্তায় সুরা নয়নপুর। এবার উত্তরমুখে কিমি তিনেক দূরে, সুরতপুর গ্রাম।

- Advertisement -
Latest news
Related news