
শশাঙ্ক প্রধান : ১৪ তারিখ, নবমীর দিন সকালে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা থেকে হাওড়া গিয়েছিলেন রাধামোহনপুরের তাপস মান্না। সেখান থেকেই সন্ধ্যায় দুন এক্সপ্রেসে রওনা দেন উত্তরাখণ্ডের উদ্দেশ্যে। ১৬ই অক্টোবর ভোর আড়াইটা নাগাদ স্টেশনে নেমে মায়ের সঙ্গে তখনকার মত শেষ কথা হয়। মাকে জানান এবার কেদারনাথের উদ্দেশ্যে পাহাড়ে উঠবে সে। সেই শেষ কথা। এরপর আর কোনও যোগাযোগ হয়নি তাপসের সঙ্গে তাঁর পরিবারের। ইতিমধ্যে টিভি দেখে আঁতকে উঠেছে তাপসের পরিবার। দেখেছেন উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন অংশে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি আর ভয়ঙ্কর ভূমিধসের কথা। তারপর থেকেই লাগাতার ফোনে চেষ্টা করেছেন ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার কিন্ত কোনওভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তাপসের মা কাজল মান্না জানিয়েছেন, বালিচকে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শককের কার্যালয়ে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসাবে কন্ট্রাকচুয়ালে কাজ করেন তাপস। ২৫ বছর বয়সী ভ্ৰমন পিপাসু তাপস প্রতিবছরই একা একা ঘুরে বেড়ান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। যেহেতু পূজার সময় কয়েকটা দিন বেশি ছুটি পাওয়া যায় তাই ওই সময়টাকেই বেছে নেন ঘোরার জন্য। এবারেও নবমীর দিন থেকে টানা সাতদিনের ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। আর তারপরেই এই বিপত্তি। কাজল আরও জানিয়েছেন, টিভিতে বারংবার দেখাচ্ছিল যে কয়েকজন বাঙালি পর্যটকের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। এরপরই আমাদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়ে। আমরা ছেলের যেমন খোঁজ পাচ্ছিলামনা তেমনই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না ওখানকার প্রশাসনের সঙ্গে ফলে আমাদের উদ্বেগ আরও বাড়ছিল। অবশেষে বৃহস্পতিবার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। জানা গেছে এই মুহূর্তে হরিদ্বারে আশ্রয় নিয়েছে সে।
তাপস তাঁর পরিবারকে জানিয়েছে, কেদারনাথের পথেই শুরু হয়েছিল বিপর্যয় যা কিছুটা ওঠার পরই টের পাওয়া যায়। ব্যাপক বৃষ্টি শুরু হয় এবং সঙ্গে ভূমিধস। রাস্তাতেই আটকে পড়ে একটি সরাইখানাতে আশ্রয় নেয় সে। প্রচুর লোক সেখানে থাকায় কোনওভাবে একপাশে জায়গা পায়। ওখানেই কেটে যায় দেড় দিন। শোনা যাচ্ছিল বায়ুসেনার হেলিকপ্টার আসবে ওদের উদ্ধার করতে কিন্তু দুর্যোগ এতটাই বাড়তে থাকে যে হেলিকপ্টার আসতেই পারেনি। এদিকে পুরো এলাকাই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় মোবাইলে চার্জ দিতে পারা যায়নি ফলে যোগাযোগ করা যাচ্ছিলনা কারও সঙ্গে। এরপর জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী বা NDRF সহায়তায় কোনও রকম রুদ্রপ্রয়াগ অবধি পৌঁছাতে সক্ষম হয়। বুধবার সন্ধ্যা নাগাদ সেখান থেকেই নেমে এসেছে হরিদ্বারে। এখানে আসার পর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর মোবাইল চার্জ দিয়ে বাড়ির সঙ্গে যোগযোগ করা সক্ষম হয় বৃহস্পতিবার সকালে।
তাপসের বোন মামনি জানা মান্না জানিয়েছেন, ‘দাদা বেড়াতে গেলেই আমাকে প্রতিমুহূর্তেই আপডেট দেয়। কোথায় আছে, এরপর কোথায় যাবে সেটা জানায়। পারলে প্রতিটা জায়গার ছবি। এবারও ১৬তারিখ দুপুরে শেষ আপডেট পাই যে দাদা কেদারের পথে যাত্রা শুরু করেছে। কিছু ছবিও পাঠায় হোয়াটস্যাপে। তখনই দাদা বলছিল যে আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানিয়েছিল শেষ অবধি কেদারনাথ যাওয়া হবে কিনা বলতে পারছিনা। দাদার পাঠানো ছবিতেও বোঝা যাচ্ছিল আবহাওয়ার সেই বদলে যাওয়া রূপ। এরপর হঠাৎ করেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
মামনি জানান, ‘বৃহস্পতিবার সকালে দাদার কাছ থেকে জানতে পারি কেদারের পথে দিল্লির ৫জন পর্যটকের একটি দলের সঙ্গে দাদার আলাপ হয়। তাঁদের সঙ্গেই দাদা কোনও ভাবে দুদিনের মাথায় রুদ্রপ্ৰয়াগ হয়ে হরিদ্বারে নেমে এসেছে। এখন যেখানে রয়েছে সেটাও একটি খরস্রোতা নদীর পাড়। ওখানে নাকি জিনিসপত্রের দাম দশগুন হয়ে গেছে। দাদার কাছে থাকা পয়সাকড়ি নিঃশেষ প্রায়। আমরা এখনও দুশ্চিন্তায় রয়েছি। আমরা বুঝতেই পারছিনা দাদা কীভাবে ফিরবে। এখন শুনছি ট্রেন চলছে কিন্তু এত লোক ওখানে আটকে রয়েছে যে তাঁদের সবারজন্য ওই ট্রেন যথেষ্ট কিনা বুঝতে পারছিনা।’ শেষ খবর পাওয়া অবধি জানা গেছে একটি ট্রেনের টিকিট সংগ্ৰহ করতে পেরেছে তাপস।