নিজস্ব সংবাদদাতা: ভুল চিকিৎসার জন্যই মৃত্যু হয়েছে একই পরিবারের মা ও তাঁর দুই সন্তানের।, এমনই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হল দাসপুরের গ্রামীন চিকিৎসক (হাতুড়ে) অজিত পাত্রকে। শুক্রবার দাসপুর থানার জ্যোত গোবর্ধন গ্রামের গৃহবধূ মৌমিতা বেরা এবং তাঁর দুই সন্তান অভিষিক্তা এবং অভিষেক অসুস্থ হওয়ার পর এই চিকিৎসকই তাঁদের চিকিৎসা করেছিলেন।

উল্লেখ্য শুক্রবার রাত পেরুনোর পর শনিবার সকালে ফের অসুস্থ বোধ করে ৮বছরের অভিষেক। তাকে সোনাখালি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরই মৃত্যু হয় তার। এরপর অসুস্থ বোধ করেন অভিষেকের মা মৌমিতা বেরা (৩৪) এবং অভিষেকের দিদি ১১বছরের অভিষিক্তা। এই দুজন একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে শনিবার সন্ধ্যায় একের পর এক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ঘটনা সামনে আসার পরই তীব্র আলোড়ন শুরু হয় জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরে। মায়ের সঙ্গে ২ শিশুর মৃত্যু নাড়িয়ে দেয় রাজ্যকেও। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ আসে রাজ্য থেকে। স্ত্রী এবং দুই সন্তানের মৃত্যুর খবর পেয়ে শনিবার রাতেই মুম্বাই থেকে ফিরে আসেন সোনার কারিগর সুশান্ত বেরা। সুশান্ত ও চিকিৎসক অজিত পাত্রকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় অজিতকে।
যদিও এখনও অবধি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পুলিশের হাতে আসেনি। মামলার গুরুত্ব অনুভব করে ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালের পরিবর্তে ৩ মৃতদেহ পাঠানো হয়েছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সাধারণ চিকিৎসকের পরিবর্তে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরাই এই ময়নাতদন্ত করবেন। তবুও সামগ্রিক ভাবে স্বাস্থ্যদপ্তর ও পুলিশের অনুমান, চিকিৎসায় গাফিলতি ছিল ওই চিকিৎসকের। অসুস্থতার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি কারন যদি ওই ঘটনা খাদ্যে বিষক্রিয়াও হয়ে থাকে তবে তা সাধারণ বিষক্রিয়ার ঘটনা ছিলনা। চিকিৎসকের উচিৎ ছিল শুক্রবারই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে ওই তিনজনকে রেফার করা।
বিশেষ সূত্রে জানা গেছে একই স্ত্রী ও দুই সন্তান অসুস্থ হয়েছেন জানার পরই তিনি নিজের গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে বাঁশখালির ওই চিকিৎসককে ফোন করে বিষয়টি দেখতে বলেন সুশান্ত বেরা। চিকিৎসক অজিত পাত্র তাঁদের দেখেন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ, ইঞ্জেকশন ইত্যাদি দেন। এরপর তিনি সুশান্তকে জানান, ওদের অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল। এরপর বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিন্ত হন সুশান্ত, বিকল্প চিকিৎসার কথা ভাবেননি। শনিবার সকালে নিজের ভাইদের কাছ থেকে ফের যখন স্ত্রী পুত্র কন্যাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পান তখন দ্রুত তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু ততক্ষণে ৩ জনই চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে। সকালে হাসপাতালে পৌঁছেই মৃত্যু হয় ছেলের আর সন্ধ্যায় আধঘন্টার ব্যবধানে একে একে মৃত্যু হয় মেয়ে এবং স্ত্রীর।
মনে করা হচ্ছে এই ঘটনার পেছনে খাদ্যে বিষক্রিয়া নয় বরং বিষপানের ঘটনা থাকতে পারে। হতে পারে মৌমিতা দুই সন্তানকে খাবারের সঙ্গে বিষ দিয়ে নিজেও সেই খাবার খেয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে কী কারণে মৌমিতা দুই সন্তানকে বিষ খাইয়ে নিজেও বিষ খেলেন? একটি সূত্রে জানা গেছে সুশান্ত বেরারা ৪ ভাই একই বাড়ির মধ্যে থাকলেও সবাই আলাদা আলাদা থাকেন। তারমধ্যেও মৌমিতা পুরো পরিবারের সঙ্গে আরও বেশি দূরত্ব বজায় রাখতেন। মৌমিতা চাইতেন, স্বামী সুশান্ত তাঁদের মুম্বাই নিয়ে যান। সেখানেই থাকবেন তাঁরা। কিন্তু সুশান্ত যা আয় করতেন তাতে মুম্বাইতে বাড়ি ভাড়া করে থাকার সঙ্গতি ছিলনা। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মন কষাকষি ছিল। মাত্র ক’দিন আগেই সুশান্ত মুম্বাইতে গেছেন বাড়ি থেকে আর তারপরই এই কান্ড। সুশান্তর এক ভাই জানিয়েছেন, “বৌদি অসম্ভব জেদি ছিলেন। নিজে যা বলবেন সেটাই করবেন। আমাদের সঙ্গে নূন্যতম সম্পর্কও রাখতেন না। অথচ একই কম্পাউন্ডে থাকতাম আমরা।”
দাসপুরের যে নার্সিংহোমে মৌমিতা ও অভিষিক্তার শেষবেলার চিকিৎসা হয়েছিল তাঁরাও খাদ্যে বিষক্রিয়া নয় বরং বিষপানের প্রতিই আঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। বমির মধ্যে লালচে রক্তকণা ইঙ্গিত করেছে তেমনই। নার্সিংহোমের এক কর্মীর কথায়, ‘আমাদের এখানে বিষপান করা রোগী এবং ডায়রিয়া বা আন্ত্রিক রুগীও আসে। সেই অভিজ্ঞতা বলছে এটা খাদ্যে বিষক্রিয়া নয় বরং বিষপানের ঘটনা।’ কিন্তু বিষপান করার ২৪ঘন্টা পেরিয়ে মৃত্যু? উত্তর দিয়েছেন ওই কর্মী। বলেছেন, ‘ সম্ভবতঃ এটি কীটনাশক জাতীয় বিষ নয় আর সেকারণেই সাধারণ বিষের লক্ষণ এখানে চট করে পরিলক্ষিত হয়নি, গন্ধ, গেঁজলা ইত্যাদির লক্ষণ প্রকট হয়নি। আমার মনে হচ্ছে ঘাস বা আগাছা নাশক বিষ পান করেছিল ওরা। যা প্রথমে জোরালো না হলেও ধীরে ধীরে লিভার নষ্ট করে দিয়েছে। সময় লেগেছে মৃত্যু হতে। এখানেই সম্ভবতঃ ভুল করেছেন ওই চিকিৎসক।’
নার্সিং হোম সূত্রে আরও একটি বিষয় জানা গেছে যে, চিকিৎসার জন্য মা ও মেয়ে ভর্তি হওয়ার পর মেয়েটিকে চিকিৎসক ও নার্সিংহোমের কর্মীরা বারংবার জিজ্ঞাসা করেছে যে কী ঘটেছিল ওই দিন? কিন্তু মেয়েটি একটি কথাও বলেনি। নার্সিংহোমের কর্মীরা মনে করছেন, মেয়েটি কোনও কিছু আড়াল করে গেছে। সে যেমন বিষ খাওয়া বা খাওয়ানোর কথা বলেনি তেমনই এটাও বলেনি যে কোনও খাবার খাওয়ার পর থেকে তাদের সমস্যা শুরু হয়। মেয়েটির এই নীরবতা প্রমান করছে মেয়েটি সম্ভবতঃ তার মাকে বা কোনোও বিষয়কে আড়াল করতে চেয়েছে। এদিকে রবিবার ওই গ্রামীণ চিকিৎসককে আদালতে পেশ করে দু’দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। সব কিছু মিলিয়ে এই তিনজনের মৃত্যু রহস্য আরও কোনও সত্যকে সামনে আনে কী না সেটাই এখন দেখার।
যদিও চিকিৎসক অজিত পাত্রের গ্রেপ্তারে বিপরীত প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। স্থানীয় গ্রামগুলির কাছে এই গ্রামীন চিকিৎসক দেবতার মত সম্মান পেয়ে থাকেন। তিনি ভুল চিকিৎসা করবেন এটা মানতে পারছেনা বাঁশখালি, গোছাতি, জ্যোত গোবর্ধন ইত্যাদি গ্রাম। দিনে রাতে , ঝড়ে, বৃষ্টিতে দশ বারোটা গ্রামের ভরসা তিনিই। কেবল কম দামে নয়, বিনামূল্যেও গরিবের চিকিৎসা করেন বলে সুনাম রয়েছে তাঁর। ওই সব মানুষদের প্রশ্ন যখন হাসপাতালে চিকিৎসার গাফিলতিতে মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে তখন তো সরকারি চিকিৎসকদের গ্রেপ্তার করা হয়না।