নিজস্ব সংবাদদাতা: কেউ দিয়েছেন ৮লাখ, কেউ দিয়েছেন ৯লাখ! হাতে এসে গেছে স্বাস্থ্যভবন থেকে নিয়োগপত্র। তাতে সই করা ডিরেক্টর অফ হেলথ সার্ভিসেস, সই আছে এ্যডিশনাল ডিরেক্টর পার্সোনেলের। কাউকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে তো কাউকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে কিন্তু সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এমন কোনও নিয়োগ সংক্রান্ত অনুমতি দেওয়াই হয়নি স্বাস্থ্যভবন থেকে।

বিধানসভা নির্বাচনের আগে এভাবেই খড়গপুরে বসে তোলা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এমনই জানা যাচ্ছে কয়েকটি সূত্র থেকে। হাতে নিয়োগপত্র পেয়েও কাজে যোগ দিতে না পেরে সারেঙ্গা, তালডাঙরা, গোয়ালতোড়, দাঁতন, বেলদা, কেশিয়াড়ী থেকে যুবকরা খড়গপুরে এসে খুঁজছেন নেতাকে কিন্তু নেতার পাত্তা নেই। নেতা আজ কলকাতা তো কাল অন্ধ্রপ্রদেশ।
প্রতারিতরা এখন বুঝতে পারছেন যে কারও বাবার জমি বিক্রি করা টাকা, কারও বোনের বিয়ের জন্য টাকা আর কারও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করা টাকা পুরোটাই জলে গিয়েছে। এখন হাত কামড়াচ্ছেন তাঁরা যদিও এখনো অবধি পুলিশে অভিযোগ জানাননি কেউ। মনে এখনও আশা আছে, চাকরি তো গেছে যাক এখন যদি দর কষাকষি করে কিছু টাকা ফেরৎ পাওয়া যায়। আর সেই টাকার জন্য এখন খড়গপুরে ঘুরে ঘুরে জুতোর সুকতলা খসিয়ে ফেলেছেন ওই যুবকের দল। কিন্তু খড়গপুরে ঢুকলেই নেতা হওয়া।
বাঁকুড়া জেলার তালডাঙরা থানা এলাকার এক যুবক জানিয়েছেন,” স্থানীয় এক তৃনমূল নেতার সূত্র ধরেই খোঁজ মিলেছে খড়গপুরের এই নেতার। খড়গপুর রেল হাসপাতালের কাছেই ঝাঁ চকচকে অফিসে বসেই কথাবার্তা হয়েছিল জানুয়ারি মাসে। নেতার পাশে বসে ছিলেন খড়গপুরের আরও বড় নেতা। সেই নেতা মোবাইল থেকে ফোন করছিলেন কখনও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য আবার কখনও কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর মেয়রের সঙ্গে যখন এত দহরম তখন আর কোনও সন্দেহ হয়নি আমাদের। কথা হয়েছিল গ্রুপ-সি পদের জন্য। দিতে হত ১০লাখ টাকা কিন্তু বাবার একটা জমি বিক্রি করে ৮লাখ পাওয়া গেল। তার জন্য গ্রুপ-ডি পদে চাকরি হবে বলল।”
ওই যুবককে এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখ নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে জয়েন করতে হবে ২৫শে মার্চে। কিন্তু কোথায় কী? মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে যুবক জানতে পারে। স্বাস্থ্যভবন থেকে এমন কোনও নির্দেশিকাই তাঁদের কাছে। ঠিক একই ভাবে গোয়ালতোড়ের রাজবাঁধের এক যুবককে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছিল ঘাটাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি গ্রুপ-ডি পদের জন্য সেই নিয়োগপত্রের সাথে শিক্ষাগত যোগ্যতা সহ বিভিন্ন সার্টিফিকেট নিয়ে ১৫দিনের মধ্যে যোগাযোগ করতে বলা হয় ঘাটাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। যথারীতি সেখানে গিয়েও জানা যায় তাদের কাছেও নিয়োগের কোনও নির্দেশিকাই নেই।
মজার ব্যাপার এদের কাউকেই জয়েন করতে দেওয়া হয়নি নির্দিষ্ট জায়গায় অথচ এই নিয়ে পীড়াপীড়ি শুরু করলে কয়েকজনকে জানানো হয় যে তাঁদের ট্রেনিং করে তবে কাজে যোগ দেওয়ানো হবে। এবার হেলথ রিক্রুমেন্ট বোর্ডের তরফে ৪৫দিনের একটি ট্রেনিংয়ের চিঠি ধরানো হল কাউকে কাউকে যেখানে দেখা যাচ্ছে চিঠি ইস্যু করা হচ্ছে ২০২০ সালের জুন মাসের! যে ব্যক্তিকে নিয়োগপত্র দেওয়া হচ্ছে ২০২১ সালের মার্চ মাসে সেই ব্যক্তিকে তার আগের বছরের জুন মাসের ট্রেনিং করানো হয় কি করে? কয়েকজনকে আবার কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ৫ থেকে ৬দিনের একটি ‘ট্রেনিং’ করানো হয়। অথচ হেলথ রিক্রুমেন্ট বোর্ড বলছে ৪৫দিনের ট্রেনিংয়ের কথা!
নিয়োগপত্র ও বিভিন্ন অর্ডার গুলি একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে স্বাস্থ্যভবন ও হেলথ রিক্রুমেন্ট বোর্ডের লেটার হেড, সরকারি লোগো ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে। ডিরেক্টর অফ হেলথ সার্ভিসের স্বাক্ষরের জায়গায় কখনও ব্যানার্জী, কখনও অন্য পদবি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সবাই জানেন ওই পদে গত কয়েকবছর ধরেই বহাল রয়েছে অজয় চক্রবর্তী। একই ব্যক্তিকে একই চিঠিতে কখনও গ্রুপ-ডি আবার গ্রুপ-সি পদের জন্য নির্বাচিত বলা হয়েছে। গোটা প্রক্রিয়াটি দেখে আপাত: দৃষ্টিতে মনে করা হচ্ছে খোদ স্বাস্থ্যভবনের নাম ব্যবহার করে স্বাস্থ্যভবন থেকেই কেউ এই অসাধু চক্র চালাচ্ছে যার শেকড় রয়েছে খড়গপুর সহ বিভিন্ন জায়গায়। কারন কয়েকবার এই যুবকদের মোবাইলে স্বাস্থ্যভবনের ল্যান্ড লাইন থেকেও ফোন এসেছে বলে তাঁরা দাবি করেছেন।
যুবকরা দাবি করেছেন, খড়গপুরে সক্রিয় থাকা এই চক্রটির ফাঁদে বাঁকুড়ার বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও গোয়ালতোড়, বেলদা, দাঁতন, কেশিয়াড়ী এলাকা থেকে বহু যুবক পড়েছেন। খড়গপুর রেল হাসপাতালের সামনে একটি অফিস থেকেই এই এলাকায় ফাঁদ পেতে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে কোটি কোটি টাকা তোলা হয়েছে। প্রতারিত যুবকদের অনুমান শুধু খড়গপুর বসে এরকম প্রায় ৫০জনকে ভুয়ো নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে।