
নিজস্ব সংবাদদাতা: বাড়ি থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পর এক বানর ছানার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রীতিমত রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। একটি সুস্থ স্বাভাবিক সাড়ে ৩ বছরের বানর ছানাকে উদ্ধার করে নিয়ে খড়গপুর বনবিভাগের রেসকিউ সেন্টারে রাখার দু’দিনের মাথায় কী করে মারা গেল তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ আরও যে বাড়ি থেকে বানর ছানাটি তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁদেরকেও বানরের অবস্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল। যদিও সেই পরিবারই খড়গপুর বনবিভাগ থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের একটি জঙ্গলঘেরা গ্রাম থেকে ওই বানরের মৃতদেহ উদ্ধার করে।
ঘটনা গত ১৩ই ডিসেম্বরের। কেশিয়াড়ি থানার খাজরা গ্রামের অনাদি দাশর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় বানর ছানাটিকে। খড়গপুর বনবিভাগের অন্তর্গত খাজরা বিট উদ্ধার করে ছানাটিকে। অনাদি দাশ তিনবছর ধরে বানরছানাটি পুষেছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশী একটি বাচ্চাকে বানরটি আঁচড়ে দিয়েছে এই অভিযোগে ছানাটিকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও অনাদি দাশের ছেলে পরমেশ্বর জানিয়েছেন, ছেলেগুলো বারবার উত্যক্ত করায় বানরটি একজনকে আঁচড়ে দিয়েছিল।
কিন্তু ওই বানরছানাকে আমরা নিয়মিত ভ্যাকসিনেশন করাতাম। প্রতিবেশী সুলভ শত্রুতা থেকে এটা করা হয়। তবুও আমরা মেনে নিয়েছিলাম। বনদপ্তরের কাছে অনুরোধ করেছিলাম কুনি (বানরের নাম)কে যেন নজরদারিতে রাখা হয় কারন ও পোষা বানর। জঙ্গলে ছেড়ে দিলে ও খাবার জোগাড় করতে পারবেননা, ওকে অন্য পশুরা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। বনদপ্তরের আধিকারিকরা আমাদের কথা দিয়েছিলেন তাই করবেন।
১৪তারিখ খড়গপুর বনবিভাগে যায় অনাদি দাস ও তাঁর পরিবার। দেখেন একটি পাখির খাঁচার মত ছোট
খাঁচায় বানরছানাটিকে রাখা হয়েছে। সেটি হাত পা ছড়াতে পারছেনা। শীতে কাঁপছে। দাশ পরিবার জানায়, আমরা বলি ওকে একটু বড় খাঁচা দিতে, কাপড় জাতীয় কিছু দিতে কারন বাড়িতে ওকে আমরা চাদর জড়িয়ে রাখতাম। বনদপ্তরের আধিকারিক আমাদের জানালেন তাই করবেন তাঁরা। আমরা ফের অনুরোধ করলাম যাতে ওকে বনে ছাড়া না হয়। প্রয়োজনে আমাদের দিয়ে দেওয়া হোক।
১৫ তারিখ অনাদি দাশের পরিবার ঝাড়গ্রাম চিড়িখানায় গিয়ে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন যদি তাঁরা বানরটিকে এখানে এনে রাখেন তাহলে ভালো হয়। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানান, তাঁরা নিজে থেকে কিছু করতে পারবেননা। যদি খড়গপুর পাঠায় তাঁরা রাখতে পারেন। ওই দিন ফের তাঁরা খড়গপুরে আসেন। তখন বানরটি প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। দাশ পরিবার জানিয়েছেন, প্রথম প্রথম বানরটা আমাদের দেখে তাকে ছাড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করত কিন্তু সেদিন কিছুই করেছিলনা। একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। বনদপ্তর তখনও জানালো বানরটা ভালই আছে।
এরপর ১৬তারিখ ফের খড়গপুরে যায় দাশ পরিবার তখন তাঁদের জানানো হয় রাতেই বানরটিকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনে আকাশ ভেঙে পড়ে দাশ পরিবারের মাথায়। কিন্তু হাল ছাড়েননি তাঁরা। পরের দিন চলে যান আলিপুর চিড়িয়াখানায়। কথা বলেন ডেপুটি ডিরেক্টর, সহকারী ডিরেক্টর এবং কয়েকজন ভেটনারের সঙ্গে।
তাঁরা জানিয়ে দেন এরকম কোনও বানর আসেনি চিড়িয়াখানায়। দাশ পরিবারের অভিযোগ এরপর থেকে দুর্ব্যবহার শুরু করেন বনদপ্তরের লোকেরা। উল্টে ভয় দেখানো হয় বন্যপ্রাণী পোষার অভিযোগে আমাদেরই বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার।
অনাদি দাশ পেশায় চাষি এবং পূজোআচ্চায় ব্যস্ত মানুষটি বলেন, আমি ওকে শখ করে পুষিনি। বছর তিনেক আগে গ্রামের এক ব্যক্তি মাস ছয়েকের ওই বানর ছানাটিকে মাঠে ফেলে দিতে গেছিলেন কারন ওকে কুকুর কামড়ে দিয়েছিল। মাঠে ফেলে দিলে ও মরে যাবে এই ভেবে ওকে আমি বাড়িতে নিয়ে আসি। ওকে নিয়মিত ভ্যাকসিন দেওয়াতাম। খুবই শান্ত প্রকৃতির মেয়ে বানর। আদর করে কুনি বলে ডাকতাম। ওকে চেন দিয়েই বেঁধে রাখতাম। কিন্তু বাচ্চারা ওকে এতটাই উত্যক্ত করেছিল যে ও চেন ছিঁড়ে ফেলেছিল। এরপর কী করব খুঁজে পাইনি। এমন সময় এক ব্যক্তি আমাদের বলে খড়গপুর বনদপ্তর লোধাশুলির জঙ্গলে বানর ছেড়ে দেয়।
১৮ তারিখ ফের দাশ পরিবার লোধাশুলির গ্রামে গ্রামে খোঁজ করতে শুরু করে। এরপর জঙ্গলঘেরা একটি গ্রাম ছোট জামুয়ার এক বাসিন্দা জানায়, দুটি হনুমান ও একটি বানরকে এখানে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল বনবিভাগের কর্মীরা। হনুমান ২টি পালিয়েছে কিন্তু বানরটি মরে পড়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে অনাদি দাস বলেন, ‘ওকে দেখেই চিনতে পারি আমি। ওর নাকে আর কানে ফুটো করা ছিল। যেদিন ওকে বনদপ্তরের লোকেরা আমার বাড়ি থেকে নিয়ে যায় সেদিন ও বারবার আমাকে ইশারা করে বলছিল খাঁচা খুলে দিতে কিন্তু আমি পারিনি। ওকে বলেছিলাম, তুই যা, ওরা আমার চেয়েও তোকে ভালো রাখবে।’ ১৮তারিখ বানরটিকে উদ্ধার করেছে লোধাশুলি বনদপ্তর।