নিজস্ব সংবাদদাতা: ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম মহিলা নেত্রী কর্নগড়ের রানী শিরোমনি। সে লড়াইয়ের সময় জন্মই হয়নি ঝাঁসির রানীর। রানী শিরোমনির দেশেরই মেয়ে রুমা সিং।

দারিদ্র্যের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে সামিল ক্লাশ এইটের ওই এক রত্তি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন রাজ্যের নারী ও শিশু উন্নয়ন ও সমাজ কল্যান মন্ত্রী শশী পাঁজা। ২০শে নভেম্বর আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার দিবসে কলকাতার নিউটাউনের রবীন্দ্রতীর্থ প্রেক্ষাগৃহে রুমাকে ‘বীরাঙ্গনা’ পুরস্কার তুলে দিতে গিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, ‘এক অসম সমাজে দাঁড়িয়ে এই লড়াই একদিকে যেমন দারিদ্রের সঙ্গে অন্যদিকে বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক ব্যাধির সঙ্গে। আমি সম্মান জানাই এমন বীরাঙ্গনাকে’
মেদিনীপুর শহর থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই দেশের প্রথম বিদ্রোহিনীর জন্মভূমি। তাঁরই নামে নামাঙ্কিত গ্রাম শিরোমনি। এই শিরোমনি গ্রামেরই লাগোয়া ছোট্ট জনপদ বিষড়া গ্রামের রুমা সিং। শহর লাগোয়া কিন্তু পচাই, চোলাই, চুল্লুর কারবারে ছিন্নভিন্ন গরিব আদিবাসী পরিবারগুলি যাঁরা কিনা এক অর্থে রানীরই সজাতি। রুমার বাবাও সেই চোলাই আসক্ত হয়েই প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩ বছর আগে। রুমার মা চঞ্চলা সিংয়ের ওপর চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ৩টি নাবালক সন্তান মানুষ করার দায়। এই অবস্থায় একজন সহায় সম্বলহীনা দিনমজুর আদিবাসী রমণী যা ভাবে তাই ভেবেছিলেন মা চঞ্চলা সিং। নাবালিকা মেয়েকে পাত্রস্থ করে দুই ছেলেকে গায়ে গতরে বড় করা।
স্থানীয় শিরোমনী বিরসা মুন্ডা হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রুমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে । অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই বিয়ে! একথা জানার পরই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে রুমার। সে বারবার মাকে জানায় বিয়ে নয়, বরং পড়াশুনা করে মায়ের তোমার পাশে দাঁড়াবো, ভাইদের মানুষ করব, ওদের বাবার মত চোলাইয়ের চক্করে পড়তে দেবনা। কিন্তু মাকে তখন ভুল বুঝিয়ে চলেছে কিছু মানুষ। মেয়েকে বিয়ে দাও নইলে বয়ে যাবে, নাক কাটবে তোমার। মা বিয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর। নোলা জামাইও তৈরি। বাধ্য হয়ে গোপনে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রশাসনের সহযোগিতায় বিয়ে আটকে দেয় রুমা।
১৫ বছরের রুমা জানায়, ‘আমি লেখাপড়া শিখতে চাই। লেখাপড়া শিখে আমি শিক্ষিকা হতে চাই। আমার দুই ভাইকেও লেখাপড়া শেখাতে চাই। বাবা অল্প লেখাপড়া জানতেন। কিন্তু চোলাই তাঁকে খেয়ে নিয়েছিল। মা একেবারেই লেখাপড়া জানেন না। তাই আমার বিয়ে দিতে চেয়ে পাত্র খুঁজে নিয়ে ছিলেন। মাকে কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারিনি। আমি তাই প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে বিয়ে আটকেছি। প্রশাসনের লোকজন বাড়িতে এসে মাকে বোঝান। মা এখন বুঝতে পেরেছেন, অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। এখন মাও আমাকে লেখাপড়া শেখাতে চান। আমার দেশের মেয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে আর আমি এইটুকু পারবনা?’
চঞ্চলা বলেন, ‘ ভুল বুঝেছিলাম আমি। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর একটি ছেলে দেখে মেয়ের বিয়ের ঠিক করি। আমি ভেবেছিলাম কীভাবে লেখাপড়া শেখাবো? বিয়ে দিয়ে দিলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হবো! মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না। মেয়ে অফিসারদের বাড়িতে ডেকে আনে। অফিসাররা এসে আমাকে বোঝায়। এখন মনে হচ্ছে মেয়ে ঠিক করেছে। তিনি বলেন, ১৮ বছর হলেও মেয়ের বিয়ে দেবোনা। মেয়েকে লেখাপড়া শেখাবো। সামান্য বার্ধক্য ভাতা এবং মজুর খেটে সংসার চালাই। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে প্রয়োজনে আরও পরিশ্রম করব।’ শনিবার মন্ত্রীর বুকে মেয়েকে দেখে খুব খুশি তিনি।