নিজস্ব সংবাদদাতা: স্কুল কিংবা কোনও বড় প্রতিষ্ঠান অথবা ডাহি জমির মালিক, খেলার মাঠ জায়গা খুঁজে মালিকের হাজির সুভাষ মাহাত। একটাই আবেদন, ‘একটু জায়গা দেবেন? গাছ লাগাবো। গাছ লাগাবো পাখিদের জন্য, পথিকের ছায়ার জন্য।’ গাছ তো বনদপ্তর লাগায়, আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস, শাল, সেগুন।

গৃহস্থ লাগায় আম, সফেদা, নারকেল কিন্তু পাখিদের জন্য, ছায়ার জন্য গাছ যে কেউ লাগায়না। সেই যে ছোট বেলায় পড়া, ‘বনে থাকে গাছ। গাছে থেকে পাখি। পাখি ফল খায়।’ সেই সব গাছ যার ফল খায় পাখি, যার ছায়ায় পথিক বসে খানিক জিরিয়ে নিতে পারে!
সুভাষ মাহাত সেই সব গাছ লাগান। যাকে আমরা বলি বনস্পতি। বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, বহড়া। যে গাছের ফল খেয়ে হাজার হাজার পাখি বেঁচে থাকে। যে গাছ শুধু হারিয়েই যাচ্ছে, নতুন করে কেউ লাগায়না। পরিবেশে এমন সব গাছ খুবই প্রয়োজন। নাহলে পাখি বাঁচবে কী করে? পাখি না থাকলে আমরা থাকব কি করে? গাছ পাগল সুভাষের মাথায় ইকোসিস্টেম, বাস্তুতন্ত্র ঘোরে। সুভাষের মাথায় বছরের প্রতিটা সপ্তাহই তাই অরণ্য সপ্তাহ।
পশ্চিম মেদিনীপুরের গুড়গুড়িপাল থানার খড়িকা শুলি গ্রামের সুভাষ একসময় বনদপ্তরের কর্মী ছিলেন। গাছ লাগানোর ভূত সেই যে মাথায় চেপেছিল আর নামেনি ঘাড় থেকে। ২০১৮ সালে অবসর নেওয়ার পরেও তাই গাছ লাগানো চলছে। তাঁর মাথায় ভূত চাপার ঘটনাটাও অদ্ভুত। সুভাষ বলেন, ‘ বনদপ্তরের কাজের অঙ্গ হিসাবে গাছের চারা লাগানো, রোপন, দেখভাল, পরিচর্যা করতে হত। কত জায়গা বনদপ্তরের! হাজার হাজার একর ইউক্যালিপটাসের চারা বসিয়ে, ঠা ঠা রোদে বসে আছি। কোথাও একটু ছায়া নেই! সূর্যের তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তবুও থাকতে হচ্ছে কারন বিকালে আরও একবার জলসেচ দিয়ে ফিরতে হবে।”
সুভাষ বলেন, “কিন্তু আমি আর থাকতে পারছিনা, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। শেষ অবধি হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ১কিলোমিটার দুরে গিয়ে একটি বট গাছ পেলাম। কি শান্তি! দুপুরের চড়া রোদ তার তলায় কাটাচ্ছি আর দেখছি দুরদুরান্ত থেকে পাখির দল আসছে তার ডালে, তার ছায়ায় আশ্রয় নিতে। সেদিন মনে হল আচ্ছা কেউ তো বট অশ্বত্থ লাগায়না। এই গাছটা যদি নিজে থেকে না হত তবে আমি সেদিন সান স্টোকে মারা যেতাম হয়ত। এক সময় গ্রামের মানুষরা বট অশ্বত্থ প্রতিষ্ঠা করতেন, তাদের বিয়ে দিতেন মনে আছে? এসবই আসলে বৃক্ষ রোপনের প্রক্রিয়া। পাখিদের জন্য, পথিকের জন্য সেই ব্যবস্থা। এখনও চৈত্র বৈশাখে বট অশ্বত্থ গাছে কলস বাঁধার প্রথা রয়েছে।” অবসরের পর গাছের নেশা তাঁকে আরও বেশি ভর করে বসেছে।
যেহেতু বনদপ্তর বট অশ্বত্থ লাগায়না তাই এই গাছের চারা পেতে ঝক্কিও কম নয়। সুভাষ সাইকেল নিয়ে মাইলের পর মাইল ঘোরেন। পোড়োবাড়ি, ভাঙা দালান, পরিত্যক্ত ইটের প্রাচীর, কংক্রিটের বাঁধ থেকে সংগ্ৰহ করেন বট, অশ্বত্থ ডুমুর গাছের চারা । তারপর চারা গুলিকে ভাঙা প্লাস্টিকের বালতি ইত্যাদিতে লাগিয়ে লালন পালন করেন। চারা গুলি বড় হলে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক, গ্রামের লোকজনদের অনুরোধ করেন, ‘একটা বট, অশ্বত্থ গাছ লাগান না। এই গাছ হলে পরিবেশ যেমন বাঁচবে, তেমনি গাছের ফল খেয়ে পাখি গুলোও বাঁচবে।’ গাছ লাগানোর অনুরোধ করে অনেকের কাছে তিরস্কৃতও হয়েছেন। তাতেও অবশ্য দমেননি সুভাষ।
প্রতিবেশী পরিমল দাস, শেখ সাব্বির’রা বলেন, ‘ও একটা গাছ পাগল মানুষ। নিজের ছেলে মেয়েকেও মানুষ এত যত্ন করে কিনা সন্দেহ।” সুভাষ মাহাত বলেন, “১৯৭৬ সালে অস্থায়ী কর্মী হিসবে বন দপ্তরে কাজে যোগ দিয়। ১৯৮৪ সালে বনদপ্তরের স্থায়ী কর্মী। ২০১৮ সাল পর্যন্ত চাঁদড়া, নয়াবসত, গোয়ালতোড়, রামগড়, গুড়গুড়িপাল বন কর্মী হিসবে কাজ করেছি। পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বট, অশ্বত্থ, ডুমুরের মতো কত গাছ। যেগুলো খুব বেশি যত্ন করতে হয়না। খুব সহজেই বেড়ে উঠে। এই সব গাছের ফল খায় হাজার হাজার পাখি। তাই বিভিন্ন জায়গা ঘুরে চারা সংগ্রহ করে নিয়ে এসে, তাকে বড় করে লোককে বিতরণ করি, অনুরোধ করি লাগানোর জন্য। গাছ লাগানোর কথা বলে অনেকের কাছ থেকে কটুক্তিও শুনেছি। বটগাছ লাগালে বাজ পড়বে বলে অনেকে দূর দূর করে ফিরিয়েও দিয়েছেন। আমি থেমে যায়নি। আমি চারা তৈরি করে মানুষকে অনুরোধ করেই যাচ্ছি। এসব করে যদি পরিবেশকে কিছুটা বাঁচাতে পারি।”