নিজস্ব সংবাদদাতা:সমাজ শিরোমনি গোঁড়া ব্রাহ্মণদের সঙ্গে লড়াইয়ে অমোঘ সূত্রটি খুঁজে এনেছিলেন বীরসিংহের সিংহ। পরাশর সংহিতা ঘেঁটে পেয়েছিলেন সেই বিধান, “নষ্টে মৃতে প্রবরজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ/ পচস্বাপতসু নারীনাং পতিরন্যো বিধয়তে।” অর্থাৎ স্বামী মারা গেলে, সন্ন্যাস নিলে, নিখোঁজ হলে, সন্তানগ্রহনে অক্ষম হলে, অধার্মিক ও অত্যাচারী হলে পত্নী আবার বিবাহ করতে পারে। তারপর ইতিহাস!

২০২০ সালে মহিষাদলে একটি পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় নকুল ও নন্দিতার একমাত্র ছেলে ২৭ বছরের অর্ণবের। বেসরকারি কারখানার কর্মচারী অর্নবের মৃত্যুতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে ওই দম্পত্তির। সেই শোক কাটিয়ে উঠে দুজনেই বুঝতে পারেন পুত্রের অকাল মৃত্যুতে তাঁদের চেয়েও আরও বড় ক্ষতি হয়ে গেছে তাঁদের পুত্রবধূ শুভ্রার। মাত্র বছর দেড়েকের পুত্র নিয়ে সে যে অথৈ জলে। শুভ্রা অবশ্য সেই দুঃসময়ে শ্বশুর-শাশুড়িকে ছেড়ে নিজের নতুন জীবনের কথা ভাবেননি। ছেলেকে নিয়ে থেকে যান শ্বশুরবাড়িতে। সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে থাকেন শ্বশুর-শাশুড়ির। ভাবনাটা ঘাঁটি দম্পত্তির শুরু থেকেই ছিল কিন্তু অজানা আরেক অনিশ্চয়তার জীবন মানতে নারাজ ছিল পুত্রবধূটি। সবচেয়ে বড় বাধা যে বৈধব্য, সমাজ, সংস্কার। দ্বিতীয় দুশ্চিন্তা ছেলেটিকে কী চোখে দেখবে নতুন স্বামী। আর তৃতীয় চিন্তা শ্বশুর-শাশুড়ি বৃদ্ধ হলে তাঁদের কী হবে?
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞানমঞ্চের সদস্য নকুল ঘাঁটি ও তাঁর স্ত্রী নন্দিতাদেবী এবার শুরু করেন পুত্রবধূর কাউন্সিলিং। ঘাঁটি দম্পত্তি জানান, ‘প্রায় ১বছর আমরা দুজনে মিলেই বউমার সঙ্গে কথা চালিয়েছি। পড়িয়েছি বই। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রসঙ্গও এসেছে আলোচনায়। তারপর তাকে রাজী করাতে সক্ষম হই। বউমা শর্ত দেয় এমন পাত্র যদি পাওয়া যায় যে আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে এবং আমাদেরকে বউমার মা-বাবা হিসাবে মেনে নেবে তবেই বিয়ে করবে সে। এরপরই আমরা পাত্র খোঁজা শুরু করি।’
অবশেষে পাত্র মিলে যায়। পাত্র হলদিয়ার রামগোপালচকের বাসিন্দা ২৬ বছরের মধু সাঁতরা। একটি গাড়ির শোরুমের কর্মচারী তিনি। শুভ্রার সমস্ত শর্ত মেনে নিয়েই বিয়েতে রাজি হন তিনি। এরপর মধুর পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা। মধুর মা বিধবা। মধুরা দুই ভাই। দাদার মত মায়েরও দায়িত্বও মধুর। শেষমেশ আলোচনায় স্থির হয় মা কিছুদিন দাদার কাছে থাকবেন আর কিছুদিন মধু আর শুভ্রার সাথে চলে থাকবেনবেন ঘাঁটি পরিবারে। তারপর শুরু হয় বিয়ের তোড়জোড়। সোমবার নিজের বাড়িতে মধু এবং শুভ্রার চার হাত এক করে দেন নকুলবাবু ও নন্দিতাদেবী। সোনার হার পরিয়ে বরণ করে নেন নব দম্পতিকে। বিয়েতে এসেছিলেন শুভ্রা এবং মধুর পরিবারের লোকজন এবং আমন্ত্রিত অথিতিরা।
নতুন জীবনে প্রবেশের পথে চোখে জল শুভ্রার। বলেন, “জীবন আমার কাছ থেকে নিয়েছে অনেক কিন্তু দিয়েছে অনেক বেশি। কে জানত রক্তের সম্পর্ক এমন দুটো মানুষ নিজের মা বাবার চাইতেও অনেক বড় হতে পারে? আমার বাবা মা পারতেন কী এই কাজ করতে? আমার ঋণ যে আরও অনেক বেড়ে গেল!” মধু বলেছেন, ” ওঁদের উদারতাই আমাকে মুগ্ধ করেছে এই সিদ্ধান্ত নিতে। আমি জানি বড় মন না হলে এই কাজ করা যায়না। অনেক শ্বশুর শাশুড়ি এই অবস্থায় পুত্রবধূকে নিজেদের সেবা পাওয়ার লোভে দাসী করেই রেখে দেয় তাইনা?”
যদিও বিদ্যাসাগরের দেশে এই ঘটনা নতুন নয়। বরং এই ঘটনা ফিরিয়ে দিয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার বাড়জেশুয়া গ্রামের বাসিন্দা মুকুন্দ মাইতির স্মৃতি। ২০১৯ সালে পেশায় কৃষক মুকুন্দবাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পাত্রস্থ করেছিলেন তাঁরই বিধবা পুত্রবধূকে। গ্রামের গোঁড়া ব্যক্তিদের বিরূদ্ধে গিয়ে সেও ছিল আধুনিক সমাজ সংস্কারের এক নয়া আন্দোলন।