নরেশ জানা: হোলি আর দেওয়ালির মতই মিনি ইন্ডিয়া খড়গপুরের আজ কমন উৎসব মকর সংক্রান্তি। না, বরং হোলি কিংবা দেওয়ালিতে দিনের এদিক ওদিক হয় কিন্ত সংক্রান্তিতে একই দিনে উৎসবে মেতেছে বাঙালি, ওড়িয়া, তেলেগু, তামিল, গুজরাটি, পাঞ্জাবি থেকে খড়গপুর শহরের আদিবাসী সমাজ।

সংক্রান্তির আগের দিন খুবই টেনশন গেছে খড়গপুরবাসীর। বাঁশের বেড়া, কাঠের খুঁটি নিয়ে টানাটানি চলেছে রাতভর। পাড়ায় পাড়ায় ছেলের দল, ক্লাবের সদস্যরা রাত জেগে ওঁত পেতে বসেছিল। ওদিকে গৃহস্থও ঘরে জেগে রয়েছে রাতভর। দুদলই সতর্ক। গৃহস্থ অপেক্ষা করছে রাত কেটে ভোর হওয়ার আর ছেলের দল অপেক্ষা করছে কখন গৃহস্থ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মঙ্গলবার থেকে শহরে বৃষ্টি চলেছে। রাতে ঠান্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে পড়েছে। সেই শীতে যেই না গৃহস্থের চোখে ঘুম নেমেছে অমনি চড় চড় আওয়াজ। ধর ধর করতে করতেই বাঁশের বেড়া কিংবা জমিয়ে রাখা কাঠ নিয়ে হওয়া ছেলের দল। রাতে সেই আগুন জ্বলে উঠেছে বাংলো সাইড, পোর্টারখুলি, খরিদা, মালঞ্চ, মথুরাকাটি, নিউসেটেলমেন্ট থেকে সাঁজোয়ালের মাঠে। শুরু হয়ে গেল পোঙ্গল।
শুক্রবার, ১৪ই জানুয়ারি খড়গপুরের কমন উৎসবে ওয়ার্কশপ ছুটি। আজ খড়গপুরের ইন্দা, সাঁজোয়াল, খরিদা, মালঞ্চ, আরামবাটির বাঙালি পাড়ায় পাড়ায় পৌষ সংক্রান্তি। মথুরাকাটি, নয়াবস্তি, নিমপুরা, বিশ্বরঞ্জন নগর, চিত্তরঞ্জন নগরের তেলেগুরা মেতে উঠেছে পোঙ্গল উৎসবে, গোলবাজারের গুজরাটিরা আজ উত্তরায়ণ উৎসবে মগ্ন। খড়গপুর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাঞ্জাবিরা আজ বৈশাখী কিংবা লোহরি মানবেন। খড়গপুরের ওডিয়া ও কেরালিয়ানরা বাঙালির মতই পালন করবেন মকর সংক্রান্তি। বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের কেউ কেউ করছেন খিচড়ি পরব। সালুয়ার নেপালীরা আজ পালন করবেন মাঘে সংক্রান্তি আর পাশেই থাকা অসমীয়াদের আজ ভোগলি বিহু। আর খড়গপুরের পরতে পরতে মিশে থাকা বিশেষ করে সোনামুখি, গাইঘাটা, তলঝুলি, রবীন্দ্রপল্লী, তালবাগিচা, ঘাগরা জুড়ে মহা ধামসা সহযোগে আজ আদিবাসী সমাজের সাঁকরাত বা পরব।
খড়গপুরের আরও তিনটি কমন উৎসব আছে। যেমন হোলি, দেওয়ালি এবং নবরাত্রি কিন্তু এগুলোকে পুরোপুরি কমন বলা যাবেনা। যেমন খড়গপুরের বাঙালিরা যেদিন দোল খেলে অবাঙালিরা হোলি খেলে তার পরের দিন। আবার বাঙালিরা কালীপুজোর রাতেই দেওয়ালি বা দ্বিপাবলির উৎসব করেন কিন্তু অবাঙালি খড়গপুরে দিওয়ালি হয় পরের দিন। আর বাঙালিদের দুর্গাপূজার নবমীর দিনই অবাঙালি উত্তরভারতীয় সম্প্রদায় নবরাত্রির ধুমধামে মেতে ওঠেন। একমাত্র মকরসংক্রান্তির দিনটিই হচ্ছে কমন যেখানে প্রতিটি সম্প্রদায় নিজের মত করে কিন্তু সারা খড়গপুরের সাথে উৎসবে মেতে ওঠেন।
সমগ্ৰ বাঙালির সাথেই খড়গপুরের বাঙালিরাও ১২ মাসে ১৩ পার্বন করেন নিজের মত করে। ঠিক তেমনই খড়গপুরের বিহার, উত্তরভারতের অধিবাসীদের বড় উৎসব ছট বা ছটা। দক্ষিনভারতীয় বিশেষ করে অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানার অধিবাসীরা আবার খড়গপুরে মেতে ওঠেন মাতাপূজায়। ছত্তিশগড়িয়াদের নিজের উৎসব জাঁওয়ারা। পাঞ্জাবীরা মানবেন গুরুনানক জন্মতিথিতে। মারওয়াড়ি সহ সমস্ত উত্তরভারতের নিজের উৎসব দিওয়ালি, গুজরাটিদের আবার নিজেদের বড় উৎসব নয়ী বরস ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আজ পুরো খড়গপুর এক সাথে মেতে রয়েছে।
সংক্রান্তিতে বাঙালিরা পিঠেপুলি খাবে সঙ্গে কাঁচা দুধে নলেনগুড়, নতুন চালের গুঁড়ি আর নারকেল কোরা মিশিয়ে তারমধ্যে ফল কুটিয়ে মকর খাবেন। কিন্তু পুরো উত্তরভারত আজ খাবেন গুড় আর তিলের নাড়ু।তামিলরা আবার দুধ আর গুড় মিশিয়ে তার মধ্যে নতুন ‘ভাজা’ চাল এবং মুগডাল ফোটানো হয়, যতক্ষণ না সেই দুধ উথলে ওঠে; এবং দুধ উথলে ওঠার জন্য এই দিনটিতে বাড়ির বউকে বকুনি খেতে হয় না, বরং তিনি অভিনন্দিত হন, কারণ দুধ ওথলানোকে শুভলক্ষণ বলে গণ্য করা হয়, তাই সবাই উচ্চকণ্ঠে ‘পোঙ্গালো পোঙ্গল’ বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠবেন। আদিবাসীদের আজ থেকে আগামী ৩দিন জনপ্রিয় পানীয় হাঁড়িয়া পান করবেন ছেলে থেকে বুড়ো সব্বাই। সঙ্গে ধামসা মাদল সহযোগে নাচ। পরের দিন উত্তরভারত বাদে প্রায় সব্বাইয়ের ঘরে মুরগি, খাসি কিংবা শুয়োরের মাংস। যার যেমন সাধ্য। আদিবাসী আর তেলেগুদের সম্প্রদায়ের উৎসব চলবে ৪দিন ধরে। সব মিলিয়ে পৌষের শেষ দিনে জমজমাট খড়গপুর।