
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দুর্যোগ কাটিয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে দক্ষিণবঙ্গ! টানা বৃষ্টির দুর্যোগ কেটেছে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকা থেকে। আর বিপর্যয় নেমে এসেছে পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে। বাঁকুড়া, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমানে শুরু হয়েছে অঝোরধারায় বর্ষণ। আর বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত স্বাভাবিক জনজীবন। আবহাওয়া রিপোর্ট বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বাঁকুড়ায় যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা গত ৫ বছরের মধ্যে রেকর্ড। বুধবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত রাঢ়বঙ্গের এই জেলায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩৫৪.৩ মিলিমিটার। ভেঙেছে হাজার হাজার কাঁচা বাড়ি।
অজয় নদের ফুলেফেঁপে ওঠা জলের তোড়ে তলিয়ে গিয়েছেন তিন রাখাল। তাঁদের খোঁজে চলছে তল্লাশি। আর তার সঙ্গে ডিভিসি জল ছাড়ায় বিপদ আরও বাড়ছে। নবান্ন সূত্রের খবর, ডিভিসির জলে দক্ষিণবঙ্গের ৫ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই জেলাগুলি হল — হাওড়া, হুগলি, পঃ বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া। এই পাঁচ জেলা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে রাজ্য প্রশাসনের।
ডিভিসি থেকে ১ লক্ষ কিউসেক জল ছাড়ার ফলে এবং তার পাশাপাশি কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টির জেরে ফের বন্যার ভ্রুকুটি আরামবাগে। প্রশাসনের তরফ থেকে দ্বারকেশ্বর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের সরিয়ে দেওয়ার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। পাশাপাশি মাইকিং করে মানুষকে সতর্ক করার কাজও শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই আরামবাগ এলাকার বেশ কিছু পরিবারকে উঁচু এলাকায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এই সংশ্লিষ্ট ৫ জেলার ডিএমকে সর্তক থাকতে বললেন মুখ্যসচিব। সূত্রের খবর, হাওড়া, হুগলি, পঃ বর্ধমান– এই তিন জেলার জন্য ৩ কলাম সেনা চেয়ে কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছে রাজ্য সরকার। পাশাপাশি, বীরভূম ও বাঁকুড়ার জন্য তৈরি থাকতে বলা হয়েছে রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী বা এসডিআরএফকে। ইতিমধ্যেই ২ লক্ষ ৪৮ হাজার কিউসেক জল ছেড়েছে ডিভিসি।
এদিকে, অজয়ের তোড়ে ভেসে গেছে পশ্চিম বর্ধমানের সঙ্গে বীরভূমের ইলামবাজারের সংযোগকারী নির্মীয়মাণ সেতুর বিশাল কাঠামো। ভেসে গেছে পশ্চিম বর্ধমান থেকে বীরভূমের সংযোগকারী অস্থায়ী ফেরিঘাটও।
ঝাড়খণ্ডের শিকাটা ব্যারেজ থেকে বিপুল পরিমাণে জল ছাড়ার ফলেই ঘটেছে এই বিপত্তি। এমনই অভিযোগ করলেন বীরভূমের জেলাশাসক বিধান রায়। তিনি বলেন, ঝাড়খণ্ডের শিকাটা ব্যারেজ থেকে ২ দফায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। অজয় তীরবর্তী এলাকায় মাইকে প্রচার করা হচ্ছে, কিছু জনকে ত্রাণশিবিরে পাঠানো হয়েছে। এর পাশাপাশি, বীরভূমের হিংলো জলাধার থেকে ৪৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। বিপর্যয়ের আশঙ্কায় সতর্ক করা হয়েছে জেলার সমস্ত ব্লককে।
অন্যদিকে, টানা বৃষ্টিতে বেড়েছে বিভিন্ন নদীর জল। যার জেরে জলবন্দি হয়ে পড়েছে পশ্চিম বর্ধমানের বেশ কিছু এলাকা। পাশাপাশি, রাস্তায় ধস নেমেছে জামুরিয়া ও দুর্গাপুরে। আতঙ্কে এলাকার বাসিন্দারা।
জানা যাচ্ছে, আউশগ্রামের সুন্দলপুরের নদীর চরে গরু চড়াতে গিয়েছিলেন কয়েকজন রাখাল। গরু চড়ানোর ফাঁকে দুপুর ১২ টা নাগাদ তিনজন মিলে খাবার খেতে বসেছেন। তখনই আচমকা নদী জলস্তর ছাপিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল জল। বৃহস্পতিবার পূর্ব বর্ধমান জেলার আউশগ্রামের কল্যাণপুর গ্রামের কাছে অজয় নদের মাঝে তীব্র জলের স্রোতের মধ্যেই একটি চরে কোমরজলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিন গোপালক। আটকে পড়ে গরুগুলিও। খবর পেয়ে উদ্ধার করতে চলে আসে পুলিশবাহিনীও। তবে তীব্র স্রোতের মধ্যে কীভাবে উদ্ধারকাজ চলবে, তা নিয়ে কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়েন সকলে।
জলের তোড়ে কোনওভাবেই উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব হয়নি। শেষমেশ বিকেলের পর প্রশাসনের তরফে স্পিডবোট নামিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা চলে। অন্যদিকে, বীরভূমের ইলামবাজারে অজয় নদে জল বাড়তেই নবনির্মিত ব্রিজের লোহার কাঠামো ভেঙে পড়ল। ব্রিজের কোনও ক্ষতি হয়েছে কিনা, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। এই ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, জল কমলে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। অজয়ের জল বাড়তেই জয়দেবের ফেরিঘাট ডুবে গিয়েছে। এর ফলে জয়দেব হয়ে বীরভূম থেকে বর্ধমান যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাওয়া খবরে দামোদর নদে ২ লক্ষ ১০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে দুর্গাপুর ব্যারাজ থেকে। এর মধ্যে অজয় নদে ছাড়া হয়েছে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার কিউসেক জল।
এদিকে ব্যারাজ থেকে ছাড়া জলে বিপদ ঘনাচ্ছে কাঁসাই নদী সংলগ্ন পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া, ময়না, কোলাঘাট ও তমলুকের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই অবস্থা পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা, দাসপুর, ঘাটাল এবং পিংলার একাংশের। বাঁকুড়ার জল গড়িয়ে নিচে নামলে নতুন করে ঘাটাল, চন্দ্রকোনা, কেশপুরেও জল ঢোকার সম্ভবনা থেকেই যাচ্ছে। তার সঙ্গে দ্বারকেশ্বর, দামোদরে জল বাড়ায় চাপ বাড়বে শিলাবতীর ফলে বন্যার সাঁড়াশি আক্রমনের মুখে পড়ে যেতে পারে ঘাটাল মহকুমা।
এদিকে সামনেই পুজো। আর পুজোর মুখে জল ঢুকেছে ঘাটাল মহকুমার কিছু নির্মীয়মান প্যান্ডেলেও। বন্ধ হয়ে গেছে বহু মন্ডপের কাজ। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পুজো উদ্যোগতারা।চন্দ্রকোনার বসনছোড়া গ্রামপঞ্চায়েত, ভগবন্তপুর ১ ও ২ গ্রাম পঞ্চায়েত,মনোহরপুর ১ ও ২ গ্রাম পঞ্চায়েত,মানিককুন্ডু গ্রাম পঞ্চায়েত-সহ ২ ব্লকের ৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জল ঢুকতে শুরু করেছে। এইসব এলাকায় শিলাবতী নদীর বাঁধ নতুন করে ভাঙতে পারে বলে দুশ্চিন্তায় প্রহর গুনছে এলাকার মানুষজন। দেখা গেছে নদী বাঁধ যাতে না ভাঙে সেই জন্য গ্রামের মানুষ বাঁধে মাটি দিয়ে উঁচু করছেন।জলের তলায় যাতায়াতের একাধিক গ্রামীণ সড়ক। ফলে শুরু হয়েছে যাতায়াতের ভোগান্তিও।দীর্ঘদিন ধরে জলমগ্ন ছিল ঘাটাল ব্লক ও ঘাটাল পৌর এলাকা সহ দাসপুরের বেশ কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত। আবার নতুন করে যে এই সমস্ত এলাকাগুলি প্লাবিত হবে তা নিশ্চিত এলাকার মানুষজন।
সব মিলিয়ে সামনে পুজো আর পুজোর আগে যে ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতি এলাকাবাসীর পিছু ছাড়বে না একপ্রকার নিশ্চিত ঘাটাল মহকুমার বাসিন্দারা। ঘাটাল মহকুমাশাসক সুমন বিশ্বাস ইতিমধ্যে ঘাটালের ভেঙে যাওয়া বাড়িগুলি পরিদর্শনে বেরিয়েছেন। এমনকি সব ধরণের সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন পরিবারগুলিকে।
তিনি জানান, সমস্ত দিকে নজর রাখছে ব্লকের বিডিও থেকে শুরু করে মহকুমা প্রশাসনের আধিকারিকরা। সমস্ত পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন তারা। ইতিমধ্যে অনেক বন্যা কবলিত এলাকার মানুষদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এলাকার স্কুলগুলিতে।
ইতিমধ্যে বন্যা মোকাবিলায় পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন জরুরি সতর্কতামুলক ব্যবস্থা নিয়েছে। বৃস্পতিবার দুপুরে পাঁশকুড়া ব্লকে প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক করে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেন জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজি। আশ্রয় শিবিরের পাশপাশি মানুষকে উদ্ধারের জন্য উদ্ধারকারী দল তৈরি করে রাখতে বলা হয়েছে পূর্বের ৪ টি ব্লকের বিডিওদের।
পাশাপাশি বন্যা মোকাবিলায় সব রকমের প্রস্তুতি ও সতর্কতা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা বিপর্যয় ব্যবস্থাপন দপ্তরের আধিকারিক মৃত্যুঞ্জয় হালদার। এখনওএলাকার বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, পানীয় জলের কল বেশিরভাগই জলের তলায়। তবে ত্রাণ শিবির থেকে বহু মানুষ বাড়িও ফিরেছেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ৬২ হাজার মানুষ আশ্রিত ছিলেন ৩৫৭ টি ত্রাণ শিবিরে।