নরেশ জানা : বাইকের পেছনে কাউকে চাপিয়ে নিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারটা ভালো করে ধরে বসতে বলেই স্টার্ট দিত ছেলেটা। সে বাইক কখনও কখনও খড়গপুর শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গ্রামের ভেতরে। রাতদিন যেখানেই ডাক পড়ুক, তৈরি উজ্জ্বল। উজ্জ্বল খড়গপুর শহরের এক করোনা যোদ্ধার নাম।

বৃহস্পতিবারই রাজ্যে করোনার সর্বোচ্চ উলম্ফন ঘটেছে বলে খবর আসার পরই যে মানুষটার কথা সবচেয়ে বেশি করে মনে হয়েছিল তাঁর নাম উজ্জ্বল ! খড়গপুর মায়াপুর, ডিভিসি, তালবাগিচা কিংবা রবীন্দ্রপল্লী এলাকায় এক ঝাঁক নয়, আমাদের একটাই উজ্জ্বল পায়রা ছিল, যার নাম
উজ্জ্বল বিশ্বাস। করোনার তৃতীয় ঢেউ অবধারিত লকডাউন নিয়ে আসছে কিনা জানিনা তবে শুক্রবার সকাল পৌনে ৯টায় উজ্জ্বলের চলে যাওয়ায় ওর পরিবারের বাইরে সবচেয়ে যাঁদের বেশি ক্ষতি হয়ে গেল তাঁরা লকডাউনে, করোনায় বিপর্যস্ত হওয়া মানুষ। করোনা বিপর্যস্ত গত লকডাউনে ভগৎ সিং শতবার্ষিকীর হয়ে যে ছেলেরা আক্রান্ত পরিবারে দু’বেলা খাবার অথবা অক্সিজেন পৌঁছে দিয়েছে তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল উজ্জ্বল। শুধু ডিভিসি, তালবাগিচা, মায়াপুর কিংবা প্রেমবাজার সোসাইটি নয়,খড়গপুর শহরের প্রান্তিক এলাকা মালঞ্চ কিংবা শহর ছাড়িয়ে গোপালী, মলমা নির্দ্বিধায় হাসি মুখে সে বয়ে নিয়ে গেছে খাবার অথবা সিলিন্ডার।
২০২১ আমাদের সবার জীবনেই কোথাও না কোথাও মর্মান্তিক আঘাত হয়ে এসেছে, প্রিয়জন হারানোর আঘাত। শুক্রবার সেই ২০২১ এর শেষ দিনটিকে যখন তেড়েফুঁড়ে ঝেড়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম আমরা তখনই সেই শেষ দিনটাই এ বছরের সেরা আঘাত দিয়ে যাবে ভাবতে পারিনি কেউই। এ ক্ষত এত গভীরে যে সহজে নিরাময় হওয়ার নয়, হয়ত হবারই নয়। ভাবাই যাচ্ছেনা, মাত্র ৫২ বছর! আমরা সবাই হয়ত পার্ট টাইম সমাজকল্যাণ মূলক কাজ করেছি কিন্তু উজ্জ্বল ছিল একমাত্র ফুলটাইম সমাজসেবী বা পেশাদারী সমাজ সেবী। ভগৎ সিং জন্ম শতবার্ষিকী কমিটির সম্পাদক প্রদ্যোৎ দাশগুপ্ত কিংবা কমিটির অন্যতম নেতৃত্ব প্রদীপ ধর জানিয়েছেন, ‘ উজ্জ্বলের বিদায় শুধু আমাদের নয়, গোটা খড়গপুরকে নিষ্প্রভ করে দিয়ে গেল। যাকে কাজ দিতে হয়না, নিজেই দায়িত্ব তুলে নেয় কাঁধে। তেমন একজন দায়িত্বশীল মানুষ ছিলেন উজ্জ্বল। রাত ১২টা কিংবা আড়াইটা যখনই কোনও মুমূর্ষু মানুষের পরিবার অক্সিজেন চেয়ে আমাদের ফোন করেছে আমরা উজ্জ্বলকেই ফোন করেছি। উজ্জ্বল হাসি মুখে সিলিন্ডার পৌঁছে দিয়েছে। এমন ছেলে আমরা আর পাব কিনা জানিনা।’
২দিন আগেই অসুস্থ হয়েছিলেন উজ্জ্বল। বুকে ব্যথা, সামান্য অস্বস্তি। অমিয়া নার্সিং হোমের বাচ্চু দা (রঞ্জিত বিশাল)তাঁর ছেলে ডঃ দ্বিপায়ন বিশাল তখুনি উজ্জ্বলকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। উজ্জ্বলকে নিয়ে যাওয়া হয় মেদিনীপুরের নামি একটি বেসরকারি হাসপাতালে। একজন প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ তাঁর চিকিৎসা করেন। তিনি জানিয়ে দেন সেই অর্থে হার্টের কোনও সমস্যা নেই। দু-দুটো ট্রপটি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরিবারও নিশ্চিত হয়ে উজ্জ্বলকে মায়াপুরের বাড়িতে ফেরৎ আনেন। আজ সকালে ফের কয়েকটি পরীক্ষার জন্য রক্ত দেন তিন। বাচ্চুদা ও দ্বিপায়ন আরেক দফা পরীক্ষা করে আ্যনজিওগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেন। আগামীকাল একজন চিকিৎসকের তত্বাবধানে সেই পরীক্ষা হবার কথা ছিল। কিন্তু কাল অবধি থাকতে রাজী হলনা উজ্জ্বল।
শুক্রবার টিফিন নিয়ে অভ্যাস মত ছাদে উঠছিলেন উজ্জ্বল। সঙ্গে স্ত্রীও ছিলেন কিন্তু তখুনি চিৎকার করে সিঁড়িতেই পড়ে যান উজ্জ্বল। মাথা ফেটে যায়, অজ্ঞান হয়ে যান। ছুটে আসেন চিকিৎসক কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। স্ত্রী আর পুত্র ছাড়াও ৮৬ বছরের মা, দিদিকে রেখে গেছেন উজ্জ্বল। ছেলে পলিটিকনিকের ফাইনাল ইয়ার, আগামী ৫ই জানুয়ারি থেকে পরীক্ষা শুরু। ভগৎ সিং শতবার্ষিকী কমিটির উদ্যোগে সমস্ত মনীষীদের জন্মদিন কিংবা আত্মবলিদান দিবস পালনের জোগাড় যন্ত্র, সাজানো গোছানো, মালা ইত্যাদি সব কিছুর দায়িত্বেই ছিল উজ্জ্বল।
আজ বছরের শেষ দিনে পাঁজিতে কোনও যাত্রা ছিলনা তবুও ভগৎ সিং শতবার্ষিকী কমিটির সদস্য সদস্যারা তাঁকে মালা পরিয়ে শেষ যাত্রায় নিয়ে গেল ঘাগরার শ্মশানভূমিতে। সেই মালা, যা কিনা একসময় উজ্জ্বল কিনে আনত! মাঝে মাঝে মাথা নিচু করে কী যেন ভাবত উজ্জ্বল। কী ভাবছিস? প্রশ্ন করলে রহস্যময় হাসি হেসে উত্তর দিত, কী ভাবব সেটাই ভাবছি! উজ্জ্বল কী তবে এমন করেই চলে যাওয়ার কথা ভাবত? এ কেমন চলে যাওয়া উজ্জ্বল?