নিজস্ব সংবাদদাতা: মামুলি এক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে নেমে যেন কেঁচো খুঁড়তে কেউটের সন্ধান পেল খড়গপুর পুলিশ। দেখা গেল বহুমূল্য পলিমার বোঝাই লরির চালককে খুন করে খড়গপুরে তার দেহ ফেলে লরি নিয়ে চম্পট দিয়েছে দুষ্কৃতি।

গত কয়েকদিনের চেষ্টায় সেই লরি উদ্ধার করেছে পুলিশ কিন্তু খোঁজ মেলেনি দুষ্কৃতির। রোমহর্ষক এই নৃশংস খুনের ঘটনার তদন্তের স্বার্থে খুনিকে পাকড়াও করার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বড়দিনের আগের দিন ২৪শে নভেম্বর গ্রামীন খড়গপুরের অংশে হাওড়া মুম্বাই জাতীয় সড়কের রূপনারায়নপুর এলাকা থেকে একটি মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, মৃতদেহটির মুখমন্ডলেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। অনেকটা চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গেলে যেমনটা হয়। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান ছিল চলতি গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে এই ঘটনা ঘটেছে। ওই জায়গায় রাস্তার পাশে বেশকিছু পাথর পড়ে থাকায় দুর্ঘটনার তত্ত্ব কিছুটা দৃঢ় হয়। ময়নাতদন্তেও সেরকমই ইঙ্গিত মেলে।
মৃতের কাছ থেকে কোনও নাম পরিচয়ের কাগজ না মেলায় মৃতদেহটি অ-শনাক্ত অবস্থায় খড়গপুর মর্গেই পড়ে থাকে। কিন্তু গল্প ঘুরে যায় ৩ দিন পরে যখন হুগলি জেলার শ্রীরামপুর থানার নয়াবস্তির কৃষ্ণকান্ত মিশ্র খড়গপুর গ্রামীন থানায় এসে জানান যে হলদিয়া থেকে প্ল্যাস্টিক দানা বা পলিমার ভর্তি তাঁর একটি লরি (WB-17-2509) মাঝরাস্তা থেকে হাপিস হয়ে গেছে।
কৃষ্ণকান্ত পুলিশকে জানায়, ওই লরিটি ২৩শে ডিসেম্বর হলদিয়া থেকে বিকাল ৪টা নাগাদ ছেড়ে মহারাষ্ট্রের লাতুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল কিন্তু ২৪তারিখ বেলা সাড়ে ৮টার পর লরি বা চালক কারুই খোঁজ মিলছেনা। ওই দিন সাড়ে ৮টা লরির মালিক কৃষ্ণকান্ত মিশ্রের ফোন রিসিভ করে বীরেন্দ্র মাহাতো নামে এক ব্যক্তি যে কিনা জানায় যে গাড়ির আসল চালক বাবলু প্রজাপতি অসুস্থ হওয়ায় তাঁরা বর্তমানে রেশমি মেটালিকের সামনে ফৌজি ধাবায় অবস্থান করছেন।
বাবলু ঘুমোচ্ছে , ঘুম ভাঙললে বাবলুর সাথে কৃষ্ণকান্তের কথা বলিয়ে দেবেন। যদিও এরপরে আর লরি মালিক কৃষ্ণকান্ত কারও সাথে কথা বলতে পারেনি। যেহেতু লরিটির শেষ অবস্থান খড়গপুরে ছিল তাই খড়গপুর গ্রামীন থানার সঙ্গে যোগাযোগ করেন কৃষ্ণকান্ত।
কৃষ্ণকান্ত আরও পুলিশকে জানান, তাঁর অনুমান লরিটি লুট করা হয়েছে কারন অত্যাধুনিক ব্যবস্থা সম্পন্ন ওই লরির জিপিস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে যাতে লরির অবস্থান না জানা যায়। তাছাড়া জাতীয় সড়কে টোলের অর্থ দেওয়ার জন্য অনলাইন ফার্স্টট্র্যাক ব্যবস্থাও নষ্ট করা হয়েছে যাতে কোন সড়ক ধরে, কোন টোলপ্লাজা পেরিয়ে লরি যাচ্ছে তা বোঝা না যায়। পুলিশের মাথায় সাথে সাথে বিদ্যুৎ খেলে যায়। যেদিন লরিটির সঙ্গে শেষ যোগাযোগ সেদিনই পাওয়া গেছে জাতীয় সড়কের পাশে দেহ। পুলিশ দ্রুত কৃষ্ণকান্তকে আসতে বলে। কৃষ্ণকান্ত এলে পুলিশ তাকে মর্গে নিয়ে যায়। পুলিশের আশঙ্কা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়, কৃষ্ণকান্ত সনাক্ত করে মর্গে থাকা দেহই তাঁর গাড়ির চালক বাবলু প্রজাপতির।
পুলিশের কাছে দ্বিতীয় যে প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি ছিল তা হল কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে বাবলুর ফোনে শেষ যে কথা বলেছিল সেই বীরেন্দ্র মাহাতো কে? উত্তর দিয়েছে কৃষ্ণকান্তই আর সেই কাহিনী হল বাবলু কী ভাবে নিজের হত্যাকারীকে নিজেই বেছে নিয়েছিল তার। কৃষ্ণকান্ত পুলিশকে জানায়, ২৩ তারিখ হলদিয়ায় পলিমার লোড করার পর বাবলু তাঁকে জানায়, তাঁর শরীর ভালো লাগছেনা। এমন অবস্থায় একা তাঁর পক্ষে মহারাষ্ট্রের লাতুর অবধি যাওয়া সম্ভব নয়। তার একজন সহকারী চাই। কৃষ্ণকান্ত তখন কলকাতা থেকে একজন চালককে পাঠানোর কথা বলে। ওই চালক কৃষ্ণকান্ত ও বাবলুর পরিচিত। কিন্তু কৃষ্ণকান্ত ওই চালককে পছন্দ করতনা। সে বলে ওকে দিয়ে কাজ হবেনা। সে নিজে একজন চালককে চেনে তাকেই নিতে চায়।
কৃষ্ণকান্ত প্রথমে অচেনা চালককে নিতে আপত্তি করে কিন্তু বাবলু তাঁকে নিশ্চিন্ত করে এই চালক তাঁর পরিচিত ও দূরপাল্লার যাওয়ার উপযোগী। কৃষ্ণকান্তর হোয়াটস্যাপে নতুন চালকের যাবতীয় ঠিকানা, আধারকার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাঠিয়ে দেয় বাবলু। সেই নাম পরিচয় দেখে জানা যাচ্ছে এই ব্যক্তির নাম বীরেন্দ্র মাহাতো। বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের চুংরি থানার সোহারা গ্রামে। অনুমান করা হচ্ছে হলদিয়াতে বাবলুকে ফাঁদে ফেলে তার সহযোগী হিসেবে ট্রাকে উঠেছিল বীরেন্দ্র। খড়গপুরের কাছাকাছি কোথাও খাবারের সঙ্গে মাদক মিশিয়ে অথবা মদ খাইয়ে বাবলুকে অচেতন করে খুন করার পর তার দেহ ফেলে যায় বীরেন্দ্র। এরপর খড়গপুরের ফৌজি ধাবায় বিশ্রাম নিয়ে লরি নিয়ে পালায় সে। ওই দিন ফৌজি ধাবায় বিকাল অবধি গাড়িটি ছিল বলে জানা গেছে। ওই সময় একে একে গাড়ির জিপিস সিস্টেম কেটে ফেলা, ফার্স্টট্র্যাক কোড নষ্ট করা এমনকি লরির গায়ে থাকা মালিকের নাম ও ফোননম্বর ঢেকে দেওয়া স্টিকার দিয়ে।
পুলিশ বিভিন্ন সূত্রে তল্লাশি চালাতে চালাতে মঙ্গলবার রাতে নদিয়ায় নাকাশিপাড়ায় লরিটির সন্ধান পায়। লরির মধ্যে থাকা ২৯লাখ টাকার পলিমার, লরিতে ট্যাঙ্কভর্তি ডিজেল, মিউজিক সিস্টেম সবই হাওয়া করে দিয়েছে দুষ্কৃতি। পুলিশের অবশ্য সন্দেহ যে বীরেন্দ্র পরিচয়ে থাকা ব্যক্তি আদৌ আসল বীরেন্দ্র কিনা। এক পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন এটাও হতে পারে যে, ওই দুষ্কৃতি বীরেন্দ্রর কাগজপত্র জাল করে নিজের ছবি দিয়ে চালিয়েছে। একজন দুষ্কৃতি তাঁর স্বনামে এতবড় দুষ্কর্ম সচরাচর করেনা। হতে পারে বাবলুকে যে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে তা এই ব্যক্তির নিজের নয়। ফলে এই ব্যক্তিই যে বীরেন্দ্র তা না হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।