নিজস্ব সংবাদদাতা: মাত্র ৯ দিন! ৬ই ফেব্রুয়ারি সারা দেশকে কাঁদিয়ে চলে গেছিলেন ভারতীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর। আর ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলা গানে স্বর্ণযুগের ইতিহাসের ঝাঁপি বন্ধ করে দিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। শেষ লড়াইটা শুরু হয়েছিল গত ২৬শে জানুয়ারি থেকে।

পরে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে আসা হয় অ্যাপোলো হাসপাতালে (Apollo Hospital)। মঙ্গলবার সেই হাসপাতালের তরফে মেডিক্যাল বুলেটিনে জানানো হয়েছিল, গীতশ্রীর শারীরিক পরিস্থিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। সকালের দিকে তাঁর রক্তচাপ মারাত্মক ভাবে কমে যায়। তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ ভেন্টিলেশন ব্যবস্থায়। ভেসোপ্রেসার সাপোর্ট দেওয়া হয় গীতশ্রীকে। কিন্তু তবে শেষরক্ষা হল না। মঙ্গলবার সন্ধ্যার মুখেই আসে সেই হৃদয় বিদারক খবরটি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষর তরফে জানানো হয় মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় চিরতরে ডানা স্তব্ধ করে প্রয়াত হয়েছেন বাংলা গানের রঙিন প্রজাপতি। বাংলা গানের স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে আগেই একে একে বিদায় নিয়েছিলেনন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়রা একে একে চলে গিয়েছেন আগেই। এ বার নিভে গেল সন্ধ্যা-প্রদীপও।
১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। ছোট বয়স থেকেই শুরু গানের শিক্ষা। সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন পণ্ডিত সন্তোষকুমার বসু, এটি কানন, অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। এছাড়াও গুরু হিসেবে পেয়েছেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান (Bade Ghulam Ali Khan) এবং তাঁর পুত্র মুনব্বর আলি খানকে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দীর্ঘ শিক্ষার পর একসময় আসেন প্লে ব্যাক সিঙ্গিং-এ। ১৯৪৮ সালে ‘অঞ্জন গড়’ ছবিতে প্রথম প্লে ব্যাক করেন তিনি। তারপর ‘সব্যসাচী’, ‘পহেলা আদমি’, ‘সাজা’সহ বহু ছবিতে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে শোনা যায় তাঁর গলা। একটা সময় মুম্বইতে থেকে রীতিমতো বলিউডে গান গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। যদিও কয়েক বছর পর ব্যক্তিগত কারণেই ফিরে আসেন কলকাতায়। মোট ১৭টি হিন্দি ছবিতে প্লে ব্যাক সিঙ্গারের ভূমিকায় পাওয়া যায় তাঁকে।
একইভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের বাজারেও প্লে ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ‘জয়জয়ন্তী’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘সন্ধ্যা দীপের শিখা’, ‘সপ্তপদী’র মতো সিনেমায় তাঁর গাওয়া গান এভার গ্রিন হয়েই থেকে গিয়েছে। সেই সময়ের আরও এক বিখ্যাত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (Hemanta Mukhopadhyay) সঙ্গে ডুয়েটে শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন বহু গান। তাছাড়া রবীন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতা ঘোষের সঙ্গেও প্রচুর কাজ করেছেন সন্ধ্যা। ব্যক্তিগত জীবনে কবি শ্যামল গুপ্তর সঙ্গে বিয়ে হয় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। তিনিও সন্ধ্যার বহু গানের লিরিক্স লিখেছেন। তবে ছায়াছবির গান গাইলেও নিজের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রেওয়াজ কখনোই বন্ধ করেননি সন্ধ্যা। প্লে ব্যাক সিঙ্গারের পাশাপাশি একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও যথেষ্টই খ্যাতি অর্জন করেন তিনি।
‘মধুমালতী’র মতো নিজের কণ্ঠের জাদুতে কয়েক দশক ধরে সংগীত জগৎকে মাতিয়ে রেখেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়া এলাকায় জন্ম শিল্পীর। ৬ ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে ছোট। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি অনুরাগ। পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি কান্নান, অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে তাঁর শিক্ষা শুরু। ছিলেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁর শিষ্যা। মুম্বইয়ে নিজের কেরিয়ার শুরু করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। রাইচাঁদ বড়াল, শচীন দেববর্মনের মতো সংগীত পরিচালকের তত্ত্বাবধানে ‘আঞ্জান গড়’, ‘তরানা’র মতো সিনেমার গানে নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছিলেন।
মুম্বাই থেকে কলকাতায় চলে আসার পরই বাংলা গানের দুনিয়ায় নতুন যুগ সংযোজন করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। শুরু হয়েছিল বাংলার সুরেলা জগতের এক নতুন অধ্যায়। ‘সপ্তপদী’, ‘পথে হল দেরী’, ‘অগ্নি পরীক্ষা’, ‘দেওয়া নেওয়া’, ‘পিতা পুত্র’ – একের পর এক সিনেমায় তাঁর কণ্ঠের জাদু শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে বললে কম বলা হবে। বলা যায়, বাঙালির সাংস্কৃতিক মননে যোগ করেছে এক অভূতপূর্ব মাইলফলক। এক সময় নাকি সুচিত্রা সেনের কন্ঠ হিসেবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কাউকেই ভাবতে পারতেন না সংগীত পরিচালকরা।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীর সঙ্গে জুটি বেঁধে বহু কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন গীতশ্রী। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ‘জয় জয়ন্তী’, ‘নিশিপদ্ম’ সিনেমায় গান গেয়ে। পেয়েছেন বঙ্গ বিভূষণ। ১৯৬৬ সালে কবি ও গীতিকার শ্যামল গুপ্তকে বিয়ে করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। শিল্পীর গাওয়া বহু গানের কথাই শ্যামল গুপ্তর লেখা। এত সুর, এত গানের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। প্রজাতন্ত্র দিবসের ঠিক আগেই তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কার দিতে চেয়েছিল কেন্দ্র সরকার। অভিমানে তা প্রত্যাখ্যান করেন শিল্পী। “মেরা দিল নাহি চাহতা হায়। আর একটা কথা জেনে রাখুন। আমার শ্রোতারাই আমার পুরস্কার।” স্পষ্ট ভাষায় দিল্লির আমলাকে জানিয়ে দেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই অহংকার নিয়েই চলে গেলেন বাংলা গানের মুকুটহীন সাম্রাজ্ঞী।