
নিজস্ব সংবাদদাতা: অবিরাম চুরি ছিনতাইয়ের শহরে মন ভালো করা খবর এনে দিয়েছে ছেলেটা। গ্যাংস্টার আর মাফিয়া, ডনের রেল তালুকে এক অন্যরকম ভূমিকায় বি. স্যামুয়েল। কালিকট ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরাজিতে পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট করা স্যামুয়েল শুক্রবার রাতে খড়গপুর শহরের গোলবাজার ব্রিজের ওপর এক জোম্যাটো বয়ের কাছ থেকে মোবাইল ছিনতাইকরা দুষ্কৃতিদের তাড়া করে ১জনকে ধরতেও সক্ষম হয়েছে। তাঁর সেই অদম্য সাহসিকতাকে পুরস্কৃত করল খড়গপুর পুলিশ। ২৪ঘন্টার মধ্যেই খড়গপুর টাউন থানার উদ্যোগে স্যামুয়েলকে সম্বর্ধিত করার পাশাপাশি কিছু উপহার তুলে দেওয়া হল। খড়গপুরের দায়িত্বে থাকা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (Adl SP) রানা মুখার্জী এবং খড়গপুর টাউন থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক (IC) বিশ্বরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় স্যামুয়েলকে সম্বর্ধিত ও পুরস্কৃত করেন। উপস্থিত ছিলেন খড়গপুরের প্রাক্তন বিধায়ক ও চেয়ারম্যান প্রদীপ সরকার। তিনিও ধন্যবাদ জানান স্যামুয়েলকে।
গোলবাজার সংলগ্ন ২০নম্বর ওয়ার্ডে বেড়ে ওঠা স্যমুয়েলের। বাবা-মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে চারজনের সংসার। ক্রিশ্চান পরিবারের স্যমুয়েলের উচ্চ মাধ্যমিক অবধি খড়গপুরে পড়াশুনার পর ওড়িশার বেহরামপুর সিটি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স সহ স্নাতক হন। এরপর ওখানকারি কালিকট ইউনিভার্সিটি থেকে এম.এ। বাবা তেলেগু ইউনিয়ন ব্যাপ্টিস্ট চার্চের দেখাশোনা সুবাদে সামান্য কিছু রোজগার করেন। সংসারের পাশে দাঁড়াতেই একটি অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছেন স্যামুয়েল।
শহরের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে সেই ব্যবসা খুলেছেন বর্তমানে সেখানেই থাকেন। অর্ডার মত কেক সরবরাহ করে বেড়ান শহর জুড়ে। সেই কাজ সেরেই গোলবাজার ব্রিজ পেরিয়ে রাত পৌনে ১০টা নাগাদ ঝাপেটাপুরে ফেরার পথেই এক জোম্যাটো বয়ের মোবাইল ছিনতাই হবার পরই ছিনতাইবাজদের তাড়া করেন। এবং একজনকে ধরেও ফেলেন, বাকিটা ইতিহাস। স্যামুয়েলের সেই ৩কিলোমিটার তাড়া করাই রাতারাতি যেন তাকে হিরো বানিয়ে দিয়েছে শহরের।
শুক্রবার রাত ভর ঘুম হয়নি স্যমুয়েলের। কেবলই ফোন এসেছে ভালোবাসা আর অভিনন্দন জানিয়েছেন মানুষ। ভালো কাজ করার এত আনন্দ আগে কখনও পাননি। শুক্রবার রাতে গোলবাজার ব্রিজ থেকে ৩ কিলোমিটারেরও বেশি তাড়া করে ধরেছিলেন তিন ছিনতাইবাজের ১জনকে। রাত ১২টা নাগাদ সেই খবর প্রকাশিত হয় ‘KGP বাংলা’ নিউজ চ্যানেলে। ‘দ্য খড়গপুর পোষ্ট’ ফেসবুক পেজে সেই খবর আপলোড হওয়ার পরই শুরু হয়েছে অভিনন্দনের ঝড়। ফোন এসেছে পুলিশ আধিকারিকদের কাছ থেকেও। তাঁর সাহসিকতাকে প্রশংসার পাশাপাশি অভিনন্দন জানিয়েছেন তাঁরা। স্যামুয়েল অবশ্য জানিয়েছেন, ‘আমি এই শহরের একজন সহ নাগরিক হিসাবে ওই জোম্যাটো বয়ের পাশে দাঁড়িয়েছি মাত্র। মোবাইল ছিনতাই হয়ে যাওয়ার পর ভেঙে পড়েছিল ওই যুবকটি। ওই মোবাইলেই ওর অর্ডার আসে, মোবাইল ছাড়া ও ডেলিভারিও করতে পারবেনা। আমিও অনলাইনে কেকের ব্যবসা করি। ওর কান্না আমারও কান্না। তাই বাইক ঘুরিয়ে তাড়া করেছিলাম। আমরা সব্বাই যদি আমাদের কর্তব্যটুকু করি তাতেই অনেকটা ভালো হয়ে যায় এই শহরের। তা না করে আমরা শুধু এর ওর দোষ ধরতেই ব্যস্ত হয়ে যাই।’
স্যামুয়েলকে যেন দেবদূত মনে করছেন সেই
জোম্যাটো বয়। ওই জোম্যাটো বয়ের নাম অবিনাশ শঙ্কর। খড়গপুর শহরের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের অবিনাশ জানাচ্ছেন, আমি কৌশল্যা এলাকায় খাবার ডেলিভারি করার পর সুভাষপল্লী যাচ্ছিলাম আরেকটা ডেলিভারি করার জন্য। গোলবাজার ব্রিজের ওপর কাস্টমারের ফোন এসেছিল। আমি কানে চেপে কথা বলছিলাম। তখনই তিনজন স্কুটি আরোহীর ১জন আমার ফোনটা ছিনিয়ে চলে যায়। আমি চিৎকার করছিলাম।
অনেকেই দেখেছেন, পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন কিন্তু একজনকে দেখলাম বাইক ঘুরিয়ে ছিনতাইবাজদের তাড়া করে গেল। তারপর আমি থানায় যাই। থানা আমাকে বলে শনিবার সকালে মোবাইলের ডকুমেন্ট নিয়ে এসে কমপ্লেন করতে। এরপর রাতে একটি ফেসবুক পেজে (The Kharagpur Post) দেখতে পাই ওই যুবক এক ছিনতাইবাজকে ধরেছে। অনেক ধন্যবাদ ওই যুবককে। ওই রকম মানুষরা শহরে যত বাড়বে ততই নিরাপদ হবে এই শহর। বিশেষ করে আমাদের মত মানুষদের যাদের অনেক রাত অবধি খাবার ডেলিভারি করতে হয়। আমি স্যালুট জানাই স্যামুয়েলকে।
খরিদা বাজারে স্যমুয়েলের তাড়ায় দুষ্কৃতীরা সাইকেলে ধাক্কা মেরে স্কুটি নিয়ে পড়ে যায়। স্কুটি সহ একজন ধরা পড়ে যায় জনতার হাতে। খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল পৌঁছায়। তখনই ঘটনা শুনে স্যামুয়েলকে তাঁর সাহসিকতার জন্য অভিনন্দন জানায় পুলিশ আধিকারিক ও পুলিশ কর্মীরা। ঘটনার খবর পৌঁছায় শীর্ষ পুলিশ আধিকারিকদের কাছেও। তাঁরাও স্যমুয়েলের প্রশংসা করার পাশাপাশি তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। খড়গপুর মহকুমার দায়িত্বে থাকা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রানা মুখার্জী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘ওই যুবকের সাহসিকতা এই শহরের অন্যদের কাছে দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণার কাজ করেছে। পুলিশের তরফে আমরা স্যামুয়েলকে সম্বর্ধিত করার কথা ভাবছি। সমাজে এই ধরনের মানুষদের খুবই প্রয়োজন।’